সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম ও ফজিলত

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম ও ফজিলত জানতে হলে পুরো আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়া জরুরি। এটি একটি বিশেষ নফল নামাজ, যার মাধ্যমে একজন মুমিন আল্লাহর নৈকট্য, রহমত ও সন্তুষ্টি অর্জনের অপূর্ব সুযোগ লাভ করে। সালাতুত তাসবিহ এমন একটি ইবাদত যা বান্দাকে আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সালাতুত-তাসবিহ-নামাজের-নিয়ম
নবী করিম (সা.) এর হাদীস অনুযায়ী, এই নামাজ নিয়মিত পড়লে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত, জানা-অজানা, প্রকাশ্য ও গোপন সব ধরনের গুনাহ মাফের আশ্বাস দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। এমনকি ১০ বছর পর্যন্ত পূর্বের গোনাহসমূহও ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত এই নামাজের গুরুত্ব অনুধাবন করে আমলে আনা।

পোস্ট সূচিপত্রঃ সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম ও ফজিলত

সালাতুল তাসবিহ কি?

সালাতুত তসবিহ‌ (صلاة تسبيح )‌ একটি আরবি বাক্য যেটাকে বাংলায় তাসবিহের নামাজ বলা হয়। সালাত শব্দের অর্থ নামাজ আর তাসবিহ বলতে, سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি, ওয়া-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ এ শব্দগুলোকে বোঝানো হয়েছে। যে নামাজে এই তাসবীহ পড়া হয় তা সালাতুত তাসবীহ বা তাসবীহের নামাজ হিসেবে পরিচিত। এটা বাধ্যতামূলক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মতো নয়। 
আমাদের নবী, হযরত মুহাম্মদ (স.) তাঁর অনুসারীদেরকে এ নামাজ পালনে উৎসাহিত করছেন। জীবনে একবার হলেও মুসলমানরা যেনো এ নামাজ পড়ে এ বিষয়ে তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। রাসুল (স.) তার চাচা, হযরত আব্বাস (রা.)-কে বলেন, চাচা, পারলে আপনি সালাতুত তাসবিহ নামাজ দিনে একবার, তা না পারলে সপ্তাহে একবার, তাও না হলে মাসে একবার, তাও না পারলে বছরে একবার পড়বেন। তাতেও অক্ষম হলে অন্তত জীবনে একবার হলেও এ নামাজ পড়বেন। এ নামাজ দ্বারা জীবনের ছোট, বড়, স্বেচ্ছায়, অনিচ্ছায়, নতুন, পুরনো, গোপন, প্রকাশ্য সব রকম গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম

প্রথমেই আমরা সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। সালাতুত তাসবীহ একটি নফল নামাজ। চার রাকায়া'ত বিশিষ্ট এই নামাজটি যে কোন সূরা দিয়ে যে কোন সময়ে (নামাজের নিষিদ্ধ সময় ছাড়া) পড়া যায়। প্রতি রাকাতে ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি, ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ তাসবীহগুলো ৭৫ বার করে পড়তে হয়। চার রাকাতে মোট (৭৫ × ৪) ৩০০ বার পড়তে হয়। নিচে সালাতুত তাসবীহ নামাজ পড়ার নিয়ম দেওয়া হলো।

কিয়ামঃ প্রথম রাকাতে সানা পড়ার পর, সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, এই তাসবীহ ১৫ বার পড়তে হবে। তারপর সূরা ফাতিহার সাথে অন্য একটি সূরা মিল করতে হবে। এরপর দাঁড়ানো অবস্থায় রুকুতে যাওয়ার পুর্বে সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ১০ বার পাঠ করতে হবে।

রুকুঃ এরপর রুকু করবে এবং রুকু অবস্থায় দোয়ার পর ১০ বার পড়বেন সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার। রুকু থেকে মাথা ওঠানোর পর সোজা হয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় রাব্বানা লাকাল হামদ পড়ার পর ১০ বার সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, পড়তে হবে।

সিজদাঃ তারপর সিজদায় যাবে এবং সিজদা অবস্থায় এ তাসবীহ সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার ১০ বার পড়তে হবে। সিজদা থেকে মাথা ওঠানোর পর আবার পড়বেন সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ১০ বার। পুনরায় সিজদা গিয়ে সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ১০ বার পড়তে হবে।

২য়, ৩য় ও ৪র্থ রাকাতঃ সিজদা থেকে মাথা উঠিয়ে আবার দ্বিতীয় রাকাতে একইভাবে তাসবিহ পাঠ করতে হবে। এ তাসবিহ প্রত্যেক রাকাতে ৭৫ বার করে ৪ রাকাত নামাজের প্রতি রাকাতেই একই নিয়ম অনুসারে আদায় করতে হবে। আশা করছি, সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ত

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ত অন্যান্য নামাজের মতোই করতে হয়। নফল নামাজগুলো অধিকাংশই সুন্নত। তাই নিয়তে সুন্নত বলা যাবে, সুন্নত–নফল কোনো কিছু না বলে শুধু তাকবিরে তাহরিমা দিয়ে আরম্ভ করলেও হয়ে যাবে। মুখে নিয়ত বলা সুন্নত, তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। নিয়তের মাধ্যমে ইবাদতের উদ্দেশ্য ও একাগ্রতা প্রকাশ পায়, যা সালাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিচে সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ত দেওয়া হলোঃ 

সালাতুত তাসবিহ নামাজের আরবি নিয়তঃ نَوَايْتُ اَنْ اُصَلِّىَ لِلَّّهِ تَعَالَى ارْبَعَ رَكَعَاتِ صَلَوةِ التَّسْبِيْحِ سُنَّةُ رَسُوْلِ اللَّهِ تَعَالَى مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيْفَةِ اَللَّهُ اَكْبَر

বাংলা উচ্চারণঃ নাওয়াতু আন ওসাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা আরবায়া রাকাতি সালাতিত তাসবিহি সুন্নাতু রাসুলুল্লাহি তায়ালা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা,বাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবর।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের বাংলা নিয়তঃ আমি সালাতুত তাসবিহ চার রাকাত সুন্নত নামাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে ক্যাবলামুখী হয়ে নিয়্যত করলাম,আল্লাহু আকবার।

সালাতুল তাসবিহ নামাজের ফজিলত

সালাতুত তাসবিহ নামাজের ফজিলত বলে শেষ করা যাবে না। আবু দাউদ শরীফের হাদিস নং ১২৯৭, ইবনে মাজাহ শরিফের হাদিস ১৩৮৭ তে একটি হাদিসের মাধ্যমেই সালাতুত তাসবিহ নামাজের ফজিলত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এটি এমন একটি আমল যখন আপনি তা করবেন তখন আল্লাহ তায়ালা আপনার যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। অতীত ও ভবিষ্যতের নতুন-পুরনো, ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত, জানা-অজানা, ছোট-বড় যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।
সালাতুত তাসবিহের ফজিলত সম্পর্কে প্রধানত আবু দাউদ হাদিসটি বর্ণনা করেন। ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত এই হাদিসে নবী করিম (সা.) তাঁর প্রিয় চাচা হজরত আব্বাস (রা.)-কে এ নামাজের গুরুত্ব জানিয়ে বলেন, হে চাচা! যদি সম্ভব হয় এই নামাজ প্রতিদিন একবার হলেও পড়বেন। তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে প্রতি শুক্রবার পড়বেন। যদি তাও সম্ভব না হয় তাহলে প্রতি মাসে একবার, আর যদি তাও সম্ভব না হয় তবে প্রতিবছর একবার পড়বেন। আর যদি এটাও সম্ভব না হয় তাহলে জীবনে একবার হলেও সালাতুত তাসবিহ আদায় করবেন। 

যদি তুমি এই নামাজ পড়ো আল্লাহ তোমার প্রথম ও শেষ, নতুন ও পুরনো, ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত, ছোট ও বড়, গোপন ও প্রকাশ্য সব গুনাহ মাফ করে দিবেন। এতেই আমরা বুঝতে পারছি যে, এ নামাজের ফজিলত অনেক বেশি এবং মহান আল্লাহ তায়ালা এসব নামাজের মাধ্যমে জীবনের ছোট-বড়, ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেন। তাই প্রতিটা মুসলিম জাতির উচিত বছরে একবার হলেও এই সালাত আদায় করা।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের দোয়া

সালাতুত তাসবিহ নামাজ মূলত একটি বিশেষ নফল ইবাদত, যা মুসলমানদের জন্য একটি মহামূল্যবান উপহার। এই নামাজে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলি স্মরণ করে তাসবিহ পাঠ করা হয়। এই দোয়াটির মাধ্যমে একজন মুসলিম আল্লাহর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও বিনয় প্রকাশ করেন। এটি আত্মার পরিশুদ্ধি, পাপ মোচন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের এক অপূর্ব মাধ্যম।  তাসবিহটি নিচে আরবী ও বাংলা উচ্চারণসহ দেওয়া হলোঃ
সালাতুত-তাসবিহ-নামাজের-দোয়া
আরবি উচ্চারণঃ سُبْحاَنَ اللهِ وَالْحَمدُ للهِ وَلآَ اِلَهَ اِلاَّ اللهُ وَاللهُ اَكْبرُ

বাংলা উচ্চারণঃ সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার।

এই তাসবিহটি সালাতুত তাসবিহ নামাজের মূল দোয়া বা জিকির হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এটি মহান আল্লাহর প্রশংসা ও মহত্ব প্রকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদিস শরীফে এসেছে, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর চাচা হজরত আব্বাস (রা.)-কে এ নামাজ পড়তে তাগিদ দেন এবং বলেন, এ নামাজ পাপমোচনের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তাসবিহটির অর্থ ও গুরুত্ব নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলোঃ

১. সুবহানাল্লাহ (سُبْحَانَ اللَّهِ) অর্থঃ আল্লাহ পবিত্র। এটি দ্বারা আমরা আল্লাহকে সব ধরনের অপূর্ণতা, দুর্বলতা এবং খারাপ ধারণা থেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করি। আমরা স্বীকার করি, আল্লাহ সর্বদিক থেকে নিখুঁত।

২. আলহামদু লিল্লাহ (الْحَمْدُ لِلَّهِ) অর্থঃ সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। এই বাক্যে আমরা স্বীকার করি যে, পৃথিবীর যাবতীয় ভালো ও উপকারমূলক বিষয়ের আসল মালিক আল্লাহ। সকল প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য।

৩. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ) অর্থঃ আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। এটি ইসলামের মূল ভিত্তি, ‘তাওহীদ’-এর ঘোষণা। এটি দ্বারা আমরা বিশ্বাস করি যে, একমাত্র আল্লাহই পূজ্য ও উপাস্য, তিনিই আমাদের স্রষ্টা, রিজিকদাতা ও রক্ষণকারী।

৪. আল্লাহু আকবার (اللَّهُ أَكْبَرُ) অর্থঃ আল্লাহ মহান। এ বাক্যে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের ঘোষণা করা হয়। তিনি সব কিছুর চেয়ে বড়, সব শক্তির উৎস তিনিই।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের সময়

সালাতুত তাসবিহ নামাজের জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিন বা সময় বাধ্যতামূলক নয়। তবে বিশেষ রাত ও সময়গুলোতে এই নামাজ আদায় করলে তা অধিক ফজিলতপূর্ণ হয়ে থাকে। সালাতুত তাসবিহ নামাজ একটি বিশেষ নফল নামাজ, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে নিজের গুনাহ মাফের জন্য প্রার্থনা করে। যেহেতু এটি একটি নফল ইবাদত, তাই সময় ও সুযোগ বুঝে যতবার সম্ভব আদায় করা যায়, ততই কল্যাণ ও পাপমোচনের সম্ভাবনা বাড়ে।

নিষিদ্ধ সময়ঃ ইসলাম ধর্মে নামাজ আদায়ের জন্য কিছু নির্দিষ্ট সময় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যেসব সময়ে সালাতুত তাসবিহসহ অন্য কোনো নফল নামাজ আদায় করা জায়েজ নয়। এই নিষিদ্ধ সময়গুলো তিনটি

  • প্রথমত, সূর্যোদয়ের সময় যখন সূর্য ওঠা শুরু করে, তখন থেকে প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর্যন্ত নামাজ পড়া নিষেধ।
  • দ্বিতীয়ত, জেনিথ সময়, অর্থাৎ যখন সূর্য ঠিক মাথার উপরে থাকে, তখন ছায়া থাকে না এবং সে সময় নামাজ আদায় করা বৈধ নয়।
  • তৃতীয়ত, সূর্যাস্তের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে মাগরিবের আজানের আগ মুহূর্তে যখন সূর্য অস্ত যায়, তখনও নামাজ নিষিদ্ধ।
এই তিনটি সময় ব্যতীত সালাতুত তাসবিহ নামাজ আদায় করা জায়েজ। বাকি সময়ে, বিশেষ করে রাতের নিরব ও প্রশান্ত মুহূর্তে এই নামাজ আদায় করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

উত্তম সময়সমূহঃ সালাতুত তাসবিহ নামাজের উত্তম সময়গুলো হলো: শবে কদর, শবে বরাত, শবে মেরাজ, রমজান মাসের দিন ও রাত (নিষিদ্ধ সময় ছাড়া) এবং তাহাজ্জুদের সময়। এ সময়গুলোতে নামাজ আদায় করলে বেশি ফজিলত ও সওয়াব পাওয়া যায়। নিচে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলোঃ

  • শবে কদর, রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিঃ শবে কদরের রাতে কুরআন নাজিল হয়েছে এবং এই রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। তাই এই রাত ইবাদতের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। এ সময় সালাতুত তাসবিহ আদায় করা অত্যন্ত ফজিলতের কাজ।
  • শবে বরাতঃ শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতকে শবে বরাত বলা হয়। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের গুনাহ ক্ষমা করেন। এ সময় সালাতুত তাসবিহ আদায় করলে গুনাহ মাফের এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়।
  • শবে মেরাজঃ মিরাজের রাতে আল্লাহর রাসূল (সা.) আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন। এই রাতে ইবাদতের বিশেষ ফজিলত আছে। তাই সালাতুত তাসবিহ আদায়ের জন্য এই রাতও অত্যন্ত উপযোগী।
  • রমজান মাসঃ পুরো রমজান মাস ইবাদতের মৌসুম। এ মাসে প্রতিটি ইবাদতের সওয়াব ৭০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। তাই রমজানের রাত কিংবা দিনেও (নিষিদ্ধ সময় ছাড়া) সালাতুত তাসবিহ নামাজ আদায় করলে অনেক বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।
অতিরিক্ত সময়ঃ সালাতুত তাসবিহ নামাজ আদায়ের জন্য কিছু অতিরিক্ত সময় রয়েছে, যেগুলো বিশেষ ফজিলতপূর্ণ। প্রতি জুমার রাতে বা দিনে এই নামাজ আদায় করা যায়, কারণ জুমার দিন ইসলামে মর্যাদাপূর্ণ। তেমনি প্রতিদিন তাহাজ্জুদ নামাজের পর সালাতুত তাসবিহ পড়া অত্যন্ত বরকতময়, কারণ রাতের ইবাদত বেশি কবুল হয়। এছাড়া কেউ গুনাহ করে অনুতপ্ত হলে, আন্তরিকভাবে তওবার ইচ্ছা থেকে এই নামাজ আদায় করলে গুনাহ মাফের আশায় আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার এক উত্তম মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। এসব সময় সালাতুত তাসবিহ পড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক।

সালাতুত তাসবিহ নামাজ সুন্নত না নফল?

সালাতুত তাসবিহ নামাজ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন এটি কি সুন্নত, নাকি নফল? ইসলামী ফিকহ ও হাদিসের আলোকে বলা যায়, সালাতুত তাসবিহ নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ নফল নামাজ। এটি নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর চাচা হজরত আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলেন, সম্ভব হলে প্রতিদিন একবার উত্তম। তবে প্রতিদিন সম্ভব না হলে অন্তত সপ্তাহে, মাসে কিংবা বছরে একবার পড়া উচিত।
আর তাও যদি সম্ভব না হয় সে ক্ষেত্রে সারাজীবনে অন্তত একবার হলেও যেন পড়ে। এই নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ জীবনের ছোট, বড়, স্বেচ্ছায়, অনিচ্ছায়, নতুন, পুরনো, গোপন, প্রকাশ্য সব রকম গুনাহসমূহ মাফ করে দেবেন। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ) এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, সালাতুত তাসবিহ নামাজ গুনাহ মোচনের জন্য এক বিশেষ সুযোগ। যদিও এটি ফরজ বা ওয়াজিব নয়, তবে নবী করিম (সা.) নিজে তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে শিখিয়ে তা পড়তে উৎসাহিত করেছেন।

সালাতুত তাসবিহ ভুল হলে করণীয় 

সালাতুত তাসবিহ নামাজে তাসবিহ পাঠে ভুল হলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যেহেতু এটি একটি নফল নামাজ, তাই ভুল হলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তা সঠিক নিয়মে সংশোধন করাই যথেষ্ট। তাসবিহ ভুলে গেলে পরবর্তী বৈধ অংশে পড়ে নেওয়া যায়, তবে নিষিদ্ধ স্থানে যেমন রুকু থেকে দাঁড়ানো (কাওমা) বা দুই সিজদার মধ্যখানে তা আদায় করা যাবে না। ইচ্ছাকৃত না হলে ভুল আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। তাই মনোযোগ ও আন্তরিকতা বজায় রেখে নামাজ আদায় করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সালাতুত-তাসবিহ-ভুল-হলে-করণীয়
তাসবিহ গণনার পদ্ধতিঃ নামাজ চলাকালীন দানাদার তসবিহ ব্যবহার করা মাকরূহ বা অপছন্দনীয়। একইভাবে, আঙুলের কর বা গাঁট গোনা নিষেধ। তাসবিহ পাঠের সময় উত্তম পদ্ধতি হলো আঙুলের মাথাগুলোকে হালকাভাবে চেপে মনে মনে গুনে তাসবিহ গণনা করা। এতে মনোযোগ বজায় থাকে এবং নামাজের ভাব ও শান্তি অক্ষুণ্ণ থাকে। এই পদ্ধতি নবী করিম (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ এবং এটি ইবাদতে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করে। তাই সালাতুত তাসবিহসহ সকল নামাজে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা উত্তম ও প্রমাণিত।

তাসবিহ ভুল হলে কী করবেনঃ

  • সূরা পড়ার আগে তাসবিহ ভুলে গেলেঃ সূরা পড়ার আগে যদি তাসবিহ ভুলে যান, তবে নামাজের শেষে সূরা কেরাত পড়ার পর সেই তাসবিহ পড়ে নিতে হবে। এতে নামাজের তাসবিহ সম্পূর্ণ হবে এবং ভুল সংশোধন করা যাবে।
  • সূরা ও কিরাআতের পর তাসবিহ ভুলে গেলেঃ সূরা ও কিরাআতের পর তাসবিহ ভুলে গেলে রুকুতে গিয়ে ওই তাসবিহ পড়ে নিতে হবে। এতে নামাজের তাসবিহ পূর্ণ হবে এবং ভুলের সংশোধন হবে।
  • রুকুতে তাসবিহ ভুলে গেলেঃ রুকুতে তাসবিহ ভুলে গেলে প্রথম সিজদায় গিয়ে সেই তাসবিহ পড়ে নিতে হবে। এতে ভুল সংশোধন হয়ে নামাজ সম্পূর্ণ হয়।
  • সিজদায় যাওয়ার আগে তাসবিহ না পড়লেঃ সিজদায় যাওয়ার আগে তাসবিহ না পড়লে প্রথম সিজদাতেই তা পড়ে নিতে হবে। এতে ভুল সংশোধন হয়ে নামাজ পূর্ণতা পায়।
  • প্রথম সিজদায় তাসবিহ না পড়লেঃ প্রথম সিজদায় তাসবিহ না পড়লে দ্বিতীয় সিজদায় পড়ে নিতে হবে, তবে সিজদার মাঝখানে নয়। এতে ভুল পূরণ হবে এবং নামাজ সঠিক হবে।
  • সিজদার মাঝখানের তাসবিহ ভুলে গেলেঃ সিজদার মাঝখানের তাসবিহ ভুলে গেলে সেটি দ্বিতীয় সিজদায় পড়ে নিতে হবে। এতে নামাজের তাসবিহ সম্পূর্ণ হয় এবং ভুল সংশোধন হয়।
  • দ্বিতীয় সিজদার তাসবিহ ভুলে গেলেঃ দ্বিতীয় সিজদার তাসবিহ ভুলে গেলে পরবর্তী রাকায়াতে সূরা কেরাতের আগে সেটা পড়ে নিতে হবে। এতে নামাজের তাসবিহ সম্পূর্ণ হবে এবং ভুল পূরণ করা হবে।
  • শেষ সিজদার তাসবিহ ভুলে গেলেঃ শেষ সিজদার তাসবিহ ভুলে গেলে সালাম ফিরানোর পূর্বে সেটা পড়ে নিতে হবে। এতে নামাজের তাসবিহ সম্পূর্ণ হয় এবং ভুল সংশোধন হয়।
যেসব স্থানে ভুলের তাসবিহ আদায় করা যাবে নাঃ যেসব স্থানে ভুলের তাসবিহ আদায় করা যাবে না তা হলো ক্বওমা, অর্থাৎ রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় এবং দুই সিজদার মাঝখানের বসা সময়। এই সময়গুলোতে তাসবিহ পড়া ইসলামে নিষিদ্ধ। যদি এই সময় তাসবিহ পড়তে ভুলেও যান, তাহলে পরে তা আদায় করা যাবে না। তাই সালাতুত তাসবিহ নামাজে তাসবিহ পাঠের সময় এসব জায়গা থেকে বিরত থাকা উচিত। এতে নামাজের সৌন্দর্য বজায় থাকে এবং ইবাদত সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। সতর্কতা ও মনোযোগ দিয়ে তাসবিহ পাঠ করলে ভুলের সম্ভাবনা কমে যায়।

লেখকের মন্তব্যঃ সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম ও ফজিলত সম্পর্কিত সকল তথ্য এই আর্টিকেলে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। এ নামাজ ইসলামী ইবাদতের এক অনন্য নিদর্শন, যা পাপ মোচনের মাধ্যম এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের উত্তম উপায়। এই নামাজ নিয়মিত আদায় না করলেও অন্তত মাসে, বছরে বা জীবনে একবার আদায় করা উচিত। কেননা, এতে যে তাসবিহ পাঠ করা হয় "সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার" তা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং ঈমানকে মজবুত করে।

তাই, প্রতিটি মুসলমানের উচিত সালাতুত তাসবিহ নামাজ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা এবং তা নিয়মিত আমলে আনা। এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নফল ইবাদত, যার মাধ্যমে পাপ মোচন ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সম্ভব। এই আলোচনার মাধ্যমে সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম, উত্তম সময়, করণীয় ও তাসবিহ ভুল হলে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করি, আপনি উপকৃত হয়েছেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে এই বরকতময় নামাজ যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url