অশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অপকারিতা
অশ্বগন্ধার উপকারিতা গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমানো। এটি
কর্টিসল হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, যা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে এবং মেজাজ
উন্নত করে। অশ্বগন্ধা একটি প্রাচীন আয়ুর্বেদিক ভেষজ, যা স্বাস্থ্য উন্নতিতে
বহুমুখী উপকারিতা প্রদান করে। এটি বিশেষ করে মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য
অত্যন্ত কার্যকর।
অশ্বগন্ধার মূল উপাদানগুলো প্রদাহ-নাশক, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও স্ট্রেস রোধী
ক্ষমতা প্রদান করে। এটি স্নায়ুতন্ত্রকে প্রশমিত করে, ঘুমের গুণগত মান উন্নত করে
এবং মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ বাড়ায়। অশ্বগন্ধা শরীরের হরমোন ভারসাম্য
বজায় রাখতে সহায়ক, বিশেষ করে থাইরয়েড ও স্ট্রেস হরমোন নিয়ন্ত্রণে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পোস্ট সূচিপত্রঃ অশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অপকারিতা
- অশ্বগন্ধা কি
- অশ্বগন্ধার পুষ্টিগুণ ও উপাদান
- অশ্বগন্ধার উপকারিতা
- অশ্বগন্ধা খেলে কি হয়
- ছেলেদের জন্য অশ্বগন্ধার উপকারিতা
- মেয়েদের জন্য অশ্বগন্ধার উপকারিতা
- ছেলেদের জন্য অশ্বগন্ধা খাওয়ার নিয়ম
- গর্ভবতী মহিলাদের জন্য অশ্বগন্ধার ব্যবহার
- অশ্বগন্ধা খাওয়ার নিয়ম
- অশ্বগন্ধা সেবনে যারা সতর্ক থাকবেন
- অতিরিক্ত অশ্বগন্ধা খাওয়ার অপকারিতা
- শেষ কথাঃ অশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অপকারিতা
অশ্বগন্ধা কি
অশ্বগন্ধা একটি সুপরিচিত প্রাকৃতিক ভেষজ উদ্ভিদ, যা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় বহু
প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি ‘ইন্ডিয়ান জিনসেং’ নামেও পরিচিত, কারণ
এর প্রভাব অনেকাংশে জিনসেংয়ের মতোই শক্তি ও সহ্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অশ্বগন্ধা
গাছ সাধারণত ৩-৫ ফুট লম্বা হয়ে থাকে এবং এর মূল অংশই প্রধানত ওষুধ তৈরিতে
ব্যবহৃত হয়। এই উদ্ভিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো এটি দেহে মানসিক ও শারীরিক চাপ
কমাতে সাহায্য করে।
এটি এক ধরনের "অ্যাডাপ্টোজেন", যা দেহকে মানসিক চাপের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে
সহায়তা করে। এছাড়া এটি অনিদ্রা দূর করে, স্মৃতিশক্তি উন্নত করে এবং রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।অশ্বগন্ধা দুর্বলতা, ক্লান্তি, যৌন অক্ষমতা,
উদ্বেগ এবং ঘুমের সমস্যার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর। অনেক ক্ষেত্রে এটি ডায়াবেটিস ও
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক। সব মিলিয়ে, অশ্বগন্ধা একটি বহুমুখী ভেষজ যা
প্রাকৃতিকভাবে স্বাস্থ্যরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অশ্বগন্ধার পুষ্টিগুণ ও উপাদান
অশ্বগন্ধা একটি প্রাচীন ওষুধি গুণসম্পন্ন ভেষজ উদ্ভিদ, যা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাশাস্ত্রে বহু শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি 'ইন্ডিয়ান জিনসেং' নামেও পরিচিত এবং শরীর ও মনের উপর বিশেষ কার্যকরী প্রভাব রাখে। অশ্বগন্ধার মূল এবং পাতায় রয়েছে নানা রকম পুষ্টিকর ও রাসায়নিক উপাদান যা স্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনো অশ্বগন্ধা মূলে যা যা থাকে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
শক্তিঃ প্রতি ১০০ গ্রাম অশ্বগন্ধা মূল প্রায় ৩২০ কিলোক্যালোরি শক্তি সরবরাহ করে, যা দেহের দৈনন্দিন শারীরিক কার্যক্রম চালাতে প্রয়োজনীয়। এই শক্তি পেশি ক্রিয়া, মস্তিষ্কের কাজকর্ম এবং শরীরের অন্যান্য ক্রিয়াশীল অংশগুলোর জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করে। অশ্বগন্ধার উচ্চ শক্তি সরবরাহের ফলে ক্লান্তি কমে এবং শারীরিক সহ্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে যারা শারীরিক পরিশ্রম বেশি করেন বা দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার পর পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় আছেন তাদের জন্য এটি খুব উপকারী।
কার্বোহাইড্রেটঃ প্রতি ১০০ গ্রাম অশ্বগন্ধা মূল প্রায় ৭৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে, যা দেহে দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে। কার্বোহাইড্রেট হলো দেহের প্রধান জ্বালানি উৎস। এটি দ্রুত হজম হয়ে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয় এবং রক্ত সঞ্চারের মাধ্যমে কোষে পৌঁছে শরীরকে দ্রুত শক্তি জোগায়। ফলে, অশ্বগন্ধা শরীরের দুর্বলতা দূর করতে এবং সজীবতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
প্রোটিনঃ প্রতি ১০০ গ্রাম অশ্বগন্ধা মূলে প্রায় ৩.৯ গ্রাম প্রোটিন থাকে। প্রোটিন শরীরের পেশি গঠন, কোষের বৃদ্ধি এবং শরীরের বিভিন্ন টিস্যুর পুনর্গঠনে অপরিহার্য। এটি এঞ্জাইম, হরমোন এবং অ্যান্টিবডির মতো গুরুত্বপূর্ণ যৌগ তৈরিতেও সাহায্য করে। তাই অশ্বগন্ধার প্রোটিন শরীরের সাধারণ স্বাস্থ্য রক্ষা ও উন্নতিতে ভূমিকা রাখে।
ফ্যাটঃ অশ্বগন্ধা মূলের ফ্যাট মাত্র ০.৩ গ্রাম, যা অত্যন্ত কম এবং স্বাস্থ্যকর। কম ফ্যাটযুক্ত খাবার ওষুধি গুণসম্পন্ন হলেও শরীরের অতিরিক্ত চর্বি সঞ্চয়ের ঝুঁকি কমায় এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এছাড়া, অল্প পরিমাণ ফ্যাট দেহের কোষের গঠন এবং কিছু হরমোন তৈরিতে প্রয়োজন।
ডায়েটারি ফাইবারঃ প্রতি ১০০ গ্রাম অশ্বগন্ধা মূলে প্রায় ৪.৫ গ্রাম ফাইবার থাকে, যা হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে। ফাইবার অন্ত্রের কার্যক্ষমতা উন্নত করে, কোষ্ঠকাঠিন্য কমায় এবং পায়খানা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। এটি স্বাস্থ্যকর অন্ত্রের জন্য অপরিহার্য এবং দীর্ঘমেয়াদে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে।
ক্যালসিয়ামঃ অশ্বগন্ধা মূল প্রায় ২৩ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম সরবরাহ করে, যা হাড় ও দাঁতকে শক্তিশালী করে। ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠন ও দৃঢ়তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং হাড় ক্ষয়ের রোগ যেমন অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া, ক্যালসিয়াম পেশির সংকোচন এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায়ও সহায়ক।
আয়রনঃ প্রতি ১০০ গ্রাম অশ্বগন্ধা মূলে প্রায় ৩.৩ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে, যা রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে। হিমোগ্লোবিন দেহে অক্সিজেন পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ, তাই আয়রনের অভাব হলে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতার সমস্যা দেখা দেয়। অশ্বগন্ধা নিয়মিত সেবনে রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে এবং সার্বিক শরীরের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
এছাড়াও, অশ্বগন্ধায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বায়োকেমিক্যাল উপাদান থাকে যেমনঃ উইথানোলাইডস, অ্যালকালয়েড, সাইটোস্টেরলস, এবং স্যাপোনিনস। এসব যৌগের মধ্যে উইথানোলাইড সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টি-স্ট্রেস এবং অ্যান্টি-ক্যান্সার বৈশিষ্ট্য রাখে। অশ্বগন্ধা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে, কর্টিসল হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে, এবং মানসিক চাপ হ্রাসে সহায়তা করে।
এটি স্নায়বিক দুর্বলতা কমায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে, ও যৌনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। এছাড়া ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও এটি সহায়ক হতে পারে। প্রাকৃতিক এ উপাদানটি স্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর, যদি তা সঠিকভাবে ও পরিমিত মাত্রায় গ্রহণ করা হয়। এটি খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন, বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, থাইরয়েড সমস্যা আছে এমন ব্যক্তি বা যারা নিয়মিত ওষুধ সেবন করছেন।
অশ্বগন্ধার উপকারিতা
অশ্বগন্ধার উপকারিতা রয়েছে প্রচুর। অশ্বগন্ধা হলো প্রাচীন আয়ুর্বেদিক
ভেষজ উদ্ভিদ, যা শত শত বছর ধরে শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের জন্য ব্যবহৃত হয়ে
আসছে। এটি “ভারতীয় জিনসেং” নামেও খ্যাত, কারণ এর উপকারিতা প্রায় জিনসেং-এর
মতোই শক্তিশালী এবং বহুমুখী। আধুনিক বিজ্ঞানও অশ্বগন্ধার নানা স্বাস্থ্যগুণের
পক্ষে বহু গবেষণা করে ইতিবাচক প্রমাণ পেয়েছে। নিচে অশ্বগন্ধার প্রধান প্রধান
উপকারিতা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।
১. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ হ্রাসে সহায়কঃ অশ্বগন্ধা সেরোটোনিন ও
কর্টিসল নামক হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা মানসিক চাপ ও উদ্বেগ
কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিয়মিত অশ্বগন্ধা সেবনে উদ্বেগের মাত্রা কমে
এবং মন শান্ত থাকে। এটি ঘুমের মানও উন্নত করে, ফলে অশ্বগন্ধা উদ্বেগজনিত
অনিদ্রা ও অস্থিরতা কমাতে বিশেষ উপকারী। এটি মস্তিষ্কের ভারসাম্য বজায় রাখে,
উদ্বেগ হ্রাস করে এবং মানসিক প্রশান্তি নিয়ে আসে।
আরও পড়ুনঃ পুরুষদের জন্য বীর্যমনি গাছের উপকারিতা
২. শারীরিক সহ্যক্ষমতা ও শক্তি বৃদ্ধিঃ অশ্বগন্ধা শরীরের শক্তি
উৎপাদন প্রক্রিয়াকে উন্নত করে। এটি কোষের ভিতরে থাকা শক্তি কেন্দ্র
মাইটোকন্ড্রিয়া-র কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে শরীর বেশি কার্যকরভাবে
শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। এর ফলে ক্লান্তি ও দুর্বলতা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব
হয় এবং দৈহিক পরিশ্রম করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। যারা দৈনিক ভারী কাজ করেন,
ব্যায়াম বা খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত, তাদের শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
অশ্বগন্ধা এই ধরণের ক্লান্তিকে হ্রাস করে এবং শরীরকে দ্রুত রিফ্রেশ ও রিকোভার
করতে সাহায্য করে।
৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেঃ অশ্বগন্ধা একটি শক্তিশালী
ইমিউন বুস্টার ভেষজ, যা শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে (immune system)
সক্রিয় ও শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। এটি সাদা রক্তকণিকার কার্যক্রম বৃদ্ধি
করে এবং এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, এবং
ইমিউন-মডুলেটিং উপাদানগুলো শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণ ও রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার
শক্তি দেয়। অশ্বগন্ধা ফ্রি র্যাডিক্যাল (যা কোষ নষ্ট করে) দূর করে অক্সিডেটিভ
স্ট্রেস হ্রাস করে, ফলে কোষ ও অঙ্গগুলো দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ থাকে এবং
বার্ধক্যজনিত রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। তাই শীতকাল বা রোগ প্রবণ সময়
অশ্বগন্ধা সেবন শরীরকে সুস্থ রাখে।
৪. স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করেঃ অশ্বগন্ধা
একটি শক্তিশালী নিউরোপ্রটেকটিভ ভেষজ হিসেবে কাজ করে, যা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে
অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে। এতে থাকা
উইথানোলাইড ও অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ স্নায়ু কোষের ক্ষয় রোধ করে,
ফলে স্মৃতিশক্তি ও শেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে, ছাত্রছাত্রী, মেধা-নির্ভর
পেশাজীবী কিংবা বয়স্কদের মস্তিষ্ক সতেজ ও কার্যকর থাকে। এছাড়াও, এটি স্ট্রেস
হরমোন কর্টিসল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমিয়ে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক
কার্যক্রম বজায় রাখতে সহায়তা করে।
৫. ঘুমের সমস্যা দূর করেঃ অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবে ঘুমের গুণগত মান
উন্নত করতে সহায়ক একটি শক্তিশালী ভেষজ। এতে থাকা অ্যাডাপ্টোজেনিক যৌগ শরীর ও মনের উপর চাপ কমিয়ে এনে স্বাভাবিক ঘুমের পরিবেশ তৈরি
করে। অশ্বগন্ধা স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা কমিয়ে মস্তিষ্ককে শিথিল
করে, যা দ্রুত ঘুমোতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যারা নিদ্রাহীনতা বা মানসিক চাপের
কারণে ঘুমাতে পারেন না, তাদের জন্য এটি একটি কার্যকর সমাধান।
৬. হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখেঃ অশ্বগন্ধা পুরুষ ও মহিলাদের যৌন
স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক। পুরুষদের ক্ষেত্রে, অশ্বগন্ধা টেস্টোস্টেরন
হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। এই হরমোন পেশি বৃদ্ধি, যৌন শক্তি,
লিবিডো (যৌন আকাঙ্ক্ষা), এবং স্পার্ম উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। নিয়মিত
অশ্বগন্ধা সেবনের ফলে টেস্টোস্টেরনের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় থাকে এবং যৌন
দুর্বলতা, ক্লান্তি কিংবা প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসের মতো সমস্যাগুলোর উন্নতি হয়।
নারীদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যারা মেনোপজের ধাপে রয়েছেন বা হরমোনগত পরিবর্তনের
মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, অশ্বগন্ধা একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী ভূমিকা পালন করে।
৭. যৌন শক্তি বৃদ্ধি করেঃ অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবে যৌন শক্তি
বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এতে থাকা বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ যেমন উইথানোলাইডস ও
প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ শরীরের যৌন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে
কার্যকর ভূমিকা রাখে। অশ্বগন্ধা শরীরে নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য
করে, যা রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে। এর ফলে
পুরুষদের ক্ষেত্রে যৌন অঙ্গে রক্তপ্রবাহ বাড়ে, যা উত্তেজনা ও স্থায়িত্ব
বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এটি যৌন দুর্বলতা, ইরেকটাইল ডিসফাংশন (পুরুষাঙ্গের
দৃঢ়তা হ্রাস), এবং ক্লান্তিজনিত যৌন অক্ষমতা হ্রাসে সহায়ক হতে পারে।
৮. শক্তি এবং স্ট্যামিনা বাড়ায়ঃ অশ্বগন্ধা একটি প্রাকৃতিক
শক্তিবর্ধক ভেষজ, যা শরীরে শক্তি ও স্ট্যামিনা (সহনশীলতা) বাড়াতে
উল্লেখযোগ্যভাবে ভূমিকা রাখে। এতে থাকা অ্যাডাপ্টোজেনিক গুণ শরীরকে মানসিক ও
শারীরিক চাপ থেকে রক্ষা করে এবং ক্লান্তি দূর করে পুনরায় কর্মক্ষম করে তোলে।
এটি কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ার কার্যকারিতা উন্নত করে, যা দেহের শক্তি উৎপাদনের
কেন্দ্র। ফলে শরীর দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে পরিশ্রম করেও সহজে
ক্লান্ত হয় না। এই কারণেই অশ্বগন্ধা দীর্ঘস্থায়ী কাজ বা একটানা শারীরিক কসরত
করার সক্ষমতা বাড়াতে কার্যকর।
৯. টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি করেঃ অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবে
পুরুষদের দেহে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি পুরুষদের
যৌন স্বাস্থ্য, পেশি গঠন, শক্তি, আত্মবিশ্বাস এবং সার্বিক পুরুষত্ব ধরে রাখতে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যারা নিয়মিত অশ্বগন্ধা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করেন,
তাদের মধ্যে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। বিশেষ করে যেসব
পুরুষ শারীরিক ও মানসিক চাপের কারণে টেস্টোস্টেরনের ঘাটতিতে ভোগেন, অশ্বগন্ধা
সেই ঘাটতি পূরণে সাহায্য করে। এটি শরীরের লিউটিনাইজিং হরমোন (LH)-এর উৎপাদন
উদ্দীপিত করে, যা সরাসরি টেস্টোস্টেরনের নিঃসরণে সহায়ক।
১০. পুরুষের উর্বরতা উন্নত করেঃ অশ্বগন্ধা পুরুষের প্রজনন
স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য উপকার এনে থাকে। এটি শুক্রাণুর সংখ্যা (sperm count),
গতিশীলতা (motility) এবং গুণমান (morphology) উন্নত করতে সহায়ক। এসব
বৈশিষ্ট্যই সরাসরি পুরুষদের উর্বরতার (fertility) সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
অশ্বগন্ধা সেবনকারী পুরুষদের ক্ষেত্রেঃ শুক্রাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়,
জীবনীশক্তি ও গতিশীলতা উন্নত হয়, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস পেয়ে শুক্রাণু
কোষের ক্ষয় রোধ হয়, যৌন উত্তেজনা ও হরমোন নিঃসরণ সুষম হয়। বিশেষ করে যেসব
পুরুষ দাম্পত্য জীবনে সন্তান ধারণে সমস্যা অনুভব করেন, তাদের জন্য অশ্বগন্ধা
একটি স্বাভাবিক, নিরাপদ এবং কার্যকর ভেষজ সমাধান হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ শিমুল মূলের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম
১১. ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রন করেঃ অশ্বগন্ধা এমন একটি ভেষজ উদ্ভিদ,
যা রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এটি বিশেষ
করে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভোগা রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে। অশ্বগন্ধা সেবনে
শরীরে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ইনসুলিন হরমোন ভালোভাবে কাজ করে
এবং রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। এটি প্যানক্রিয়াসের বিটা সেল-কে
সক্রিয় করে, যা ইনসুলিন উৎপাদনেও সহায়তা করে। এছাড়া, অশ্বগন্ধার
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান রক্তনালীর প্রদাহ কমিয়ে
মেটাবলিজম উন্নত করে, যার ফলে গ্লুকোজ দ্রুত কোষে প্রবেশ করে এবং রক্তে
অতিরিক্ত গ্লুকোজ জমতে পারে না।
১২. ওজন নিয়ন্ত্রণ ও মেটাবলিজম উন্নতি করেঃ অশ্বগন্ধা এমন একটি
ভেষজ, যা শরীরের বিপাক ক্রিয়া বা মেটাবলিজম বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মেটাবলিজম
যত বেশি সক্রিয় হয়, শরীর তত দ্রুত ক্যালোরি পোড়াতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি
সরাসরি শরীরের চর্বি হ্রাস ও ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অশ্বগন্ধা কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা হ্রাস করে, যা অতিরিক্ত থাকলে
ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। কর্টিসলের উচ্চ মাত্রা অনেক সময় বেলি ফ্যাট
বা পেটের চারপাশে চর্বি জমার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অশ্বগন্ধা এই চক্র ভেঙে
শরীরকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনে।
১৩. প্রদাহ ও ব্যথা কমাতে সহায্য করেঃ অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবে
অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি (প্রদাহনাশক) গুণসম্পন্ন একটি ভেষজ, যা শরীরের বিভিন্ন
প্রদাহজনিত সমস্যা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে থাকা উইথানোলাইডস ও
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ শরীরের কোষে সৃষ্ট অস্বাভাবিক প্রদাহ প্রতিরোধে
সক্রিয়ভাবে কাজ করে। বিশেষ করে যারা অস্টিওআর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড
আর্থ্রাইটিস, বা দীর্ঘমেয়াদি মাংসপেশির ব্যথা কিংবা স্নায়ুবিক ব্যথায় ভোগেন,
তাদের জন্য অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিক ও নিরাপদ ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি
দেহের ইমিউন সিস্টেমের অতি প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং ব্যথার উৎসস্থলে
প্রশমনের অনুভূতি এনে দেয়।
১৪. রক্তচাপ ও শর্করা নিয়ন্ত্রণঃ অশ্বগন্ধা একটি শক্তিশালী
প্রাকৃতিক ভেষজ, যা রক্তচাপ এবং রক্তের শর্করা এই দুই গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য
সূচককে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। অশ্বগন্ধা দেহের স্নায়ুব্যবস্থাকে শান্ত
করে, মানসিক চাপ কমায় এবং রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে, যার ফলে উচ্চ রক্তচাপ
স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এতে থাকা অ্যাডাপ্টোজেন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
উপাদানগুলো হৃৎপিণ্ডের উপর চাপ কমায় এবং রক্তচলাচল সহজ করে, যা রক্তচাপ
নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।অশ্বগন্ধা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং গ্লুকোজের শোষণ ও
ব্যবহার প্রক্রিয়াকে উন্নত করে। এটি প্যানক্রিয়াসে ইনসুলিন নিঃসরণকে সঠিকভাবে
নিয়ন্ত্রণ করে, ফলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে।
১৫. মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করেঃ অশ্বগন্ধা এমন একটি ভেষজ,
যা নিউরোপ্রটেকটিভ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন—অর্থাৎ এটি মস্তিষ্কের কোষগুলোকে সুরক্ষা
দেয় এবং তাদের কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে। এতে থাকা উইথানোলাইডস,
গ্লাইকোউইথানোলাইডস, এবং শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানগুলি মস্তিষ্কের
কোষের ক্ষয় রোধ করে এবং নতুন কোষ গঠনে সহায়তা করে। অশ্বগন্ধা মস্তিষ্কের
স্নায়ু ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে, ফলে এটি স্মৃতি এবং মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য
করে। বিশেষ করে যারা মানসিক চাপ বা স্মৃতির সমস্যায় ভুগেন, তাদের জন্য এটি একটি
অত্যন্ত উপকারী উপাদান।
১৬. হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়ঃ অশ্বগন্ধা একটি শক্তিশালী
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ভেষজ উদ্ভিদ, যা হৃদরোগের
প্রধান ঝুঁকিগুলো নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর উপাদানগুলো
হৃদপিণ্ডকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং হৃৎপিণ্ডের
কার্যক্ষমতা বাড়ায়। এটি রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক এবং হৃদপিণ্ডের
স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। অশ্বগন্ধা এলডিএল (LDL – খারাপ কোলেস্টেরল) কমাতে ও
এইচডিএল (HDL – ভালো কোলেস্টেরল) বাড়াতে সহায়তা করে। এই ভারসাম্য রক্ষা করা
খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ খারাপ কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে ধমনিতে চর্বি জমে, যা রক্ত
চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
১৭. অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্যঃ অশ্বগন্ধা একটি প্রাকৃতিক
অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি (প্রদাহনাশক) ভেষজ, যা শরীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ হ্রাস
করতে সক্ষম। এর মধ্যে থাকা উইথানোলাইডস, সাইটোকাইন-মডুলেটর, এবং
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে
এবং অপ্রয়োজনীয় প্রদাহ প্রতিরোধ করে। অশ্বগন্ধা শরীরে সাইটোকাইন
(pro-inflammatory signals) নামক রাসায়নিক সংকেতকে নিয়ন্ত্রণ করে, যা প্রদাহ
সৃষ্টি করে। এটি TNF-alpha ও IL-6-এর মতো প্রদাহ বৃদ্ধিকারী উপাদানগুলোর পরিমাণ
কমিয়ে দেয়, ফলে প্রদাহ ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম
বজায় থাকে।
১৮. ক্যান্সার প্রতিরোধ করেঃ অশ্বগন্ধা একটি শক্তিশালী ভেষজ
উদ্ভিদ, যার মধ্যে থাকা উইথানোলাইডস (Withanolides) নামক প্রাকৃতিক যৌগ শরীরের
কোষগুলোর ডিএনএ (DNA)-কে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং কোষের অস্বাভাবিক
বৃদ্ধি বা বিভাজন যা ক্যান্সারের অন্যতম কারণ, তা প্রতিরোধ করতে সহায়তা
করে।উইথানোলাইডস অস্বাভাবিক বা ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে শনাক্ত করে অ্যাপোপটোসিস
(apoptosis) নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেগুলিকে ধ্বংস করে দেয়। এটি ক্যান্সার
সেল গঠনের প্রাথমিক ধাপগুলোকে ব্যাহত করে এবং টিউমারের বৃদ্ধি রোধ করতে সাহায্য
করে। স্তন, ফুসফুস, প্রোস্টেট ও কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে অশ্বগন্ধার
সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
১৯. পেশি ও হাড় মজবুত করেঃ অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবে পেশি বৃদ্ধি ও
হাড়ের ঘনত্ব উন্নত করতে সহায়তা করে, যা দেহের সামগ্রিক শক্তি ও সহ্যক্ষমতা
বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বিশেষ করে যেসব মানুষ দুর্বলতা, হাড়
ক্ষয়, বা পেশিশক্তি কমে যাওয়ার সমস্যায় ভোগেন, তাদের জন্য কার্যকর।অশ্বগন্ধা
শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণ ক্ষমতা বাড়িয়ে হাড়ের ঘনত্ব ও শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা
করে।এছাড়াও, হাড়ের জয়েন্টের প্রদাহ বা ব্যথা কমাতে অশ্বগন্ধার
অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান কার্যকর।
এটি শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বাড়িয়ে প্রোটিন সংশ্লেষণ উন্নত করে, যা পেশি
গঠনের মূল চাবিকাঠি। নিয়মিত অশ্বগন্ধা সেবন হাড় মজবুত করতে এবং পেশি বৃদ্ধিতে
সাহায্য করে।
২০. ত্বক ও চুলের যত্নেঃ অশ্বগন্ধা শুধু শরীরিক স্বাস্থ্যের জন্য
নয়, বরং সৌন্দর্যচর্চার ক্ষেত্রেও একটি কার্যকর প্রাকৃতিক উপাদান। এতে থাকা
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং হরমোন-সুষমকারী উপাদান ত্বক ও
চুল দুয়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অশ্বগন্ধার
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ ত্বকের কোষগুলোর অকাল বার্ধক্য প্রতিরোধ করে, যার ফলে
ত্বক দীর্ঘদিন টানটান ও তরুণ থাকে। এটি ফ্রি র্যাডিক্যাল দূর করে, যা রিঙ্কল
বা দাগ পড়ার অন্যতম কারণ। ত্বকে যদি প্রদাহ, ব্রণ বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়,
অশ্বগন্ধা সেগুলো কমিয়ে ত্বককে সুস্থ ও দীপ্তিমান রাখে। অশ্বগন্ধা চুল পড়া
কমাতে সাহায্য করে, বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে স্ট্রেস বা হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
দায়ী। এটি স্ক্যাল্পে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং চুলের গোড়া মজবুত করে।
অশ্বগন্ধা খেলে কি হয়
অশ্বগন্ধা খেলে কি হয় এ সম্পর্কে অনেকেই জিজ্ঞাসা করে থাকেন। অশ্বগন্ধা খেলে
যেসব উপকারিতা পাওয়া যায়, অশ্বগন্ধা আলসার প্রতিরোধেও সাহায্য করে। এতে
ক্যান্সার প্রতিরোধক গুণও রয়েছে, যা ক্যান্সার কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির
সংযোজন হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পারকিনসন্স, আলঝেইমার রোগের মতো
নিউরোডিজেনারেটিভ রোগে আক্রান্তদের জন্যও অশ্বগন্ধার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে বলে
জানা যায়।
এছাড়াও, অশ্বগন্ধা মানসিক চাপ কমাতে এবং ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করে।
এটি ইমিউনিটি সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং হৃদরোগের
ঝুঁকি কমাতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। অশ্বগন্ধা শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং যৌন
স্বাস্থ্য উন্নত করতেও সাহায্য করে বলে প্রমাণিত হয়েছে।অশ্বগন্ধা খেলে ছেলে
এবং মেয়েদের বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা ভালো হয়ে যায় যেমনঃ
- যৌন চাহিদা বাড়ে,
- মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কমে,
- শুক্রাণু বৃদ্ধি পায়,
- পিরিয়ড সমস্যা নিরাময় করে,
- পেশি শক্তি বাড়ে,
- শরীরের শক্তি বাড়ে,
- পুরুষ মহিলা বন্ধ্যাত্বের সমস্যা দূর হয়,
- বেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে,
- মানুষের চাপ কমে,
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে,
- প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়,
- ত্বক চুল সুন্দর রাখে,
- থাইরয়েডের সমস্যা দূর হয়
- ভালো ঘুম হয়
- ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ রাখে ইত্যাদি।
ছেলেদের জন্য অশ্বগন্ধার উপকারিতা
ছেলেদের জন্য অশ্বগন্ধার উপকারিতা অনেক বৈচিত্র্যময় এবং শরীর-মন উভয় দিক থেকে
স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে। সমস্ত ভেষজ উদ্ভিদের মধ্যে অশ্বগন্ধা অন্যতম
প্রধান যা পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। নিয়মিত অশ্বগন্ধা সেবনে
পুরুষদের মধ্যে শুধু যৌন ইচ্ছা বাড়ায় না, শুক্রাণু সংখ্যা এবং টেস্টোটেরনের হার
বৃদ্ধিতে কার্যকর। অশ্বগন্ধা বিভিন্নভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে, যেমন পাউডার,
ক্যাপসুল, বা চা হিসেবে। ছেলেদের জন্য অশ্বগন্ধার উপকারিতা হলোঃ
১. শারীরিক শক্তি ও স্ট্যামিনা বৃদ্ধি করেঃ অশ্বগন্ধা একটি
প্রাকৃতিক শক্তিবর্ধক ভেষজ, যা শরীরের অভ্যন্তরীণ শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে
সক্রিয় করে। এতে থাকা উইথানোলাইডস এবং অন্যান্য কার্যকরী উপাদান
মাইটোকন্ড্রিয়া কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ফলে শরীর দ্রুত শক্তি পায় এবং দীর্ঘ
সময় ধরে ক্লান্ত না হয়ে কাজ করতে পারে। অশ্বগন্ধা অ্যাডাপ্টোজেন হিসেবে
মানসিক ও শারীরিক চাপ কমিয়ে দেহকে চনমনে রাখে। দিনের শেষে যেসব কাজ করতে কষ্ট
হয়, সেখানে এটি সহায়তা করে।নিয়মিত সেবনে অশ্বগন্ধা পেশির সহ্যশক্তি এবং
শক্তি বহন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
২. মানসিক চাপ কমায় ও মনোযোগ বাড়ায়ঃ অশ্বগন্ধা একটি প্রাকৃতিক
অ্যাডাপ্টোজেন, অর্থাৎ এটি দেহ ও মনের স্ট্রেসের সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য
করে। মানসিক চাপ কমানো এবং মনোযোগ বৃদ্ধি—এই দুই দিকেই অশ্বগন্ধার প্রভাব
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। অশ্বগন্ধা কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমিয়ে
মস্তিষ্ককে শান্ত রাখে, ফলে অকারণে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও খিটখিটে ভাব অনেকটা
হ্রাস পায়। এটি নিউরনের কার্যক্ষমতা উন্নত করে এবং নিউরোট্রান্সমিটার (যেমন
অ্যাসিটাইলকোলিন)-এর কার্যকারিতা বাড়িয়ে শেখার ক্ষমতা, মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি
বাড়ায়। শিক্ষার্থী বা মেন্টালি সক্রিয় ব্যক্তিদের জন্য এটি খুব উপকারী।
৩. টেস্টোস্টেরন বৃদ্ধি করেঃ অশ্বগন্ধা পুরুষদের মধ্যে
টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা যৌন স্বাস্থ্য, পেশি গঠন, শক্তি ও
উর্বরতা এ সবকিছুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেস্টোস্টেরন একটি প্রধান পুরুষ
হরমোন যা যৌন আকর্ষণ, শক্তি, এবং বীর্যের গুণমান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাখে। অশ্বগন্ধা এই হরমোনের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখে এবং ঘাটতি পূরণে সহায়তা করে।
যারা নিয়মিত অশ্বগন্ধা গ্রহণ করেন তাদের শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণমান বৃদ্ধি
পায়, যা সন্তান ধারণে সহায়ক।টেস্টোস্টেরনের বৃদ্ধি যৌন ইচ্ছা (libido) ও
কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। অশ্বগন্ধা শরীরের রক্ত সঞ্চালনও উন্নত করে, যা
যৌন উত্তেজনা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
৪. যৌন আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করেঃ অশ্বগন্ধা প্রাচীনকাল থেকেই যৌন
উত্তেজক ভেষজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অশ্বগন্ধা শরীরের স্নায়ুতন্ত্রকে
শিথিল করে ও হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে, ফলে মানসিক চাপের কারণে যৌন ইচ্ছা
হ্রাস পেলে তা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। এটি পুরুষ ও নারীর উভয়ের কামভাব
জাগাতে কার্যকর। নিয়মিত সেবনে এটি শরীরের রক্তসঞ্চালন উন্নত করে, বিশেষ করে
যৌন অঙ্গে রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে ইরেকশন সমস্যার (ED) ক্ষেত্রে ভালো ফল দিতে
পারে। এটি নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদন বাড়ায়, যা পেশী শিথিল করে ও রক্তনালী
প্রসারিত করে।
৫. যৌনক্ষমতা বাড়ায়ঃ অশ্বগন্ধা একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক ভেষজ যা
নারী ও পুরুষ উভয়ের যৌনস্বাস্থ্য উন্নতিতে কার্যকর। এটি শুধু শারীরিক সক্ষমতা
নয়, মানসিক চাপজনিত যৌন দুর্বলতাও দূর করে। অশ্বগন্ধা পুরুষদের টেস্টোস্টেরন
হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা যৌন ইচ্ছা, উত্তেজনা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে
সরাসরি ভূমিকা রাখে। অশ্বগন্ধা রক্তনালীগুলোর প্রসারণ ঘটিয়ে যৌন অঙ্গে
রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি করে, যা উত্তেজনার মাত্রা বাড়ায় এবং যৌন মিলনের সময়
স্থায়িত্ব ধরে রাখতে সহায়তা করে। যৌন সক্ষমতা বাড়ার ফলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে
এবং দাম্পত্য সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়।
৬. পেশি গঠন ও হাড় মজবুত করেঃ অশ্বগন্ধা এমন একটি ভেষজ যা
শুধুমাত্র শারীরিক দুর্বলতা দূর করেই থেমে থাকে না, বরং পেশি গঠন ও হাড়ের
দৃঢ়তা বৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা পালন করে। অশ্বগন্ধা শরীরের টেস্টোস্টেরন হরমোন
বৃদ্ধি করে, যা পেশি গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি প্রোটিন সংশ্লেষণ
প্রক্রিয়া সক্রিয় করে, ফলে ব্যায়াম বা কাজের পর শরীর দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়
এবং পেশির আকার ও শক্তি বৃদ্ধি পায়। এতে থাকা ক্যালসিয়াম ও
অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান হাড়ের ক্ষয় রোধ করে এবং হাড়ের ঘনত্ব (bone
density) বাড়াতে সাহায্য করে। বয়সজনিত হাড় দুর্বলতা, যেমন অস্টিওপোরোসিস
প্রতিরোধেও অশ্বগন্ধা কার্যকর।
৭. ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করেঃ অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবে আমাদের
দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলে, যার ফলে এটি বিভিন্ন ভাইরাস,
ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। অশ্বগন্ধায়
থাকা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান যেমন উইথানোলাইডস (Withanolides)
শরীর থেকে টক্সিন দূর করে ও কোষকে সুরক্ষা দেয়, ফলে কোষের প্রতিরোধ ক্ষমতা
বৃদ্ধি পায়। এটি দেহের সাদা রক্তকণিকার সক্রিয়তা বাড়ায়, যা রোগজীবাণুর
বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে ছোটখাটো ইনফেকশন সহজেই প্রতিরোধ
করা সম্ভব হয়।
৮. ঘুমের সমস্যা দূর করেঃ অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে এবং শরীর-মনকে আরাম দেয়, যা ঘুমের মান উন্নত করতে অত্যন্ত কার্যকর। যারা নিদ্রাহীনতা বা দুশ্চিন্তার কারণে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না, তাদের জন্য অশ্বগন্ধা একটি নিরাপদ ও কার্যকর সমাধান। অশ্বগন্ধা একটি প্রাকৃতিক অ্যাডাপ্টোজেন, যা স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা কমিয়ে শরীরকে স্বাভাবিক ও শান্ত অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। কর্টিসল বেশি হলে মস্তিষ্ক অতিরিক্ত উত্তেজিত থাকে, ফলে ঘুম আসে না। এটি gamma-aminobutyric acid নামক নিউরোট্রান্সমিটারকে সক্রিয় করে, যা আমাদের মস্তিষ্ককে শান্ত করে এবং ঘুমের সংকেত পাঠায়।
৯. রক্তচাপ ও শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেঃ অশ্বগন্ধা রক্তচাপ
এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা
দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য জটিলতা কমাতে সহায়ক। এটি
শরীরের স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল কমিয়ে রক্তনালীর প্রসারণে সাহায্য করে, ফলে
রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। এছাড়া, অশ্বগন্ধা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে,
যা রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। এটি রক্তে অতিরিক্ত শর্করার জমাট
বাঁধা কমিয়ে শরীরের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে ডায়াবেটিস
রোগীদের জন্য এটি উপকারী একটি প্রাকৃতিক সমাধান হতে পারে।
বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url