ইউরিন ইনফেকশন দূর করার উপায়

ইউরিন ইনফেকশন দূর করার উপায় সম্পর্কে আজকের এই আর্টিকেলে আমি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো। ইউরিন ইনফেকশন দূর করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি ও ঘরোয়া উপায় রয়েছে। আশা করা যায় চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া উপায় অনুসরণ করলেই এই সমস্যার দ্রুত সমাধান পাওয়া যাবে।
ইউরিন-ইনফেকশন-দূর-করার-উপায়
এই সংক্রমণ নারী ও পুরুষ উভয়েরই হতে পারে, যদিও নারীদের মধ্যে এর প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। বর্তমান সময়ে ইউরিন ইনফেকশন হলে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো ডাক্তারের পরামর্শে এন্টিবায়োটিক খাওয়া। তবে শুধুমাত্র ওষুধেই নির্ভর করলে চলবে না। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘরোয়া অভ্যাস গড়ে তুললে সংক্রমণ আরও দ্রুত প্রতিরোধ করাও সহজ হয়।

পোস্ট সূচিপত্রঃ ইউরিন ইনফেকশন দূর করার উপায়

ইউরিন ইনফেকশন কি

ইউরিন ইনফেকশন, চিকিৎসা ভাষায় যাকে বলা হয় মূত্রনালীর সংক্রমণ, সংক্ষেপে UTI। ইউরিন ইনফেকশন একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা যা মূলত ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ঘটে। এটি আমাদের মূত্রনালী বা ইউরিনারি সিস্টেমের যেকোনো অংশে যেমন কিডনি, মূত্রনালী, মূত্রথলি, বা মূত্রনালীপথে জীবাণু প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়। তবে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয় মূত্রথলি এবং মূত্রনালীপথে। এটি একধরনের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ, যা নারীদের মধ্যে বেশি দেখা গেলেও পুরুষ ও শিশুদের মধ্যেও হতে পারে।
সহজ ভাষায়, আমাদের মূত্রনালী সাধারণত চারটি অংশ দ্বারা গঠিত। এই অংশ গুলো হলো কিডনি, মূত্রনালী, মূত্রথলি এবং মূত্রনালীপথ। কিডনি, যেখানে রক্ত পরিশোধিত হয়ে ইউরিন তৈরি হয়। মূত্রনালী যা ইউরিনকে কিডনি থেকে মূত্রথলিতে পৌঁছে দেয়। মূত্রথলি, যেখানে ইউরিন জমা থাকে এবং মূত্রনালীপথ, যেখান দিয়ে ইউরিন শরীর থেকে বের হয়ে যায়। উপরের এই অংশ গুলোর কোন একটি বা কোন স্থানে যদি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয় তাহলে তাকে ইউরিন ইনফেকশন বলা হয়।

এই সংক্রমণ সাধারণত তখনই ঘটে যখন Escherichia coli (E. coli) নামক একটি ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত মানুষের অন্ত্রে বাস করে, তা মূত্রনালীতে প্রবেশ করে এবং সেখানে গিয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংক্রমণ মূত্রথলি ও মূত্রনালীপথে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে অবহেলা করলে এটি কিডনি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করলে এই সমস্যা সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

ইউরিন ইনফেকশন দূর করার উপায়

ইউরিন ইনফেকশন দূর করার উপায় বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সময়মতো প্রতিরোধ বা চিকিৎসা না করলে কিডনি পর্যন্ত সংক্রমণ ছড়িয়ে জটিলতা তৈরি করতে পারে। যদি আপনার ইউরিন ইনফেকশন হয়ে থাকে, তাহলে সবার প্রথমে ও সবচেয়ে জরুরি কাজটি হলো প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা। এটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পানি আমাদের দেহের প্রাকৃতিক পরিশোধক হিসেবে কাজ করে এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে সাহায্য করে।
পানি বেশি পান করলে আপনার শরীরে প্রস্রাবের চাপ বেশি আসবে, অর্থাৎ ঘন ঘন মূত্রত্যাগ হবে। যখন আপনি বারবার প্রস্রাব করবেন, তখন মূত্রনালীর ভিতরে জমে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো প্রস্রাবের মাধ্যমে বাইরে বের হয়ে যাবে। এতে ইনফেকশনের বিস্তার রোধ হয় এবং সংক্রমণ অনেকটাই হালকা হয়ে আসে। তাই প্রস্রাব কখনোই আটকে রাখবেন না, বরং প্রস্রাব করলে কিছু সময়ের জন্য হলেও আরাম পাওয়া যায় এবং প্রতিরোধ ব্যাবস্থা সহজ হয়। জেনে নিন ইউরিন ইনফেকশন দূর করার উপায়গুলোঃ 

১. প্রচুর পানি পান করুনঃ ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধ ও উপশমের সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর উপায়গুলোর মধ্যে একটি হলো প্রচুর পানি পান করা। দিনে অন্তত ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করার চেষ্টা করুন। পানি মূত্রনালীকে প্রাকৃতিকভাবে ধুয়ে ফেলে এবং সংক্রমণের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে। তবে মনে রাখতে হবে, খুব বেশি পানি একবারে না খেয়ে দিনে সামান্য পরিমাণে বারবার পানি পান করাই বেশি কার্যকর। এতে শরীরে পানিশূন্যতা থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়।

২. চিনি ছাড়া ক্র্যানবেরি জুস পান করুনঃ ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে বা প্রাথমিক পর্যায়ে উপশমে চিনি ছাড়া ক্র্যানবেরি জুস অত্যন্ত উপকারী একটি প্রাকৃতিক পানীয়। ক্র্যানবেরি ফলের মধ্যে রয়েছে এমন কিছু অ্যান্টি-অ্যাডহেসিভ উপাদান, বিশেষ করে প্রোঅ্যান্থোসায়ানিডিন (PACs), যা ইউরিনারি ট্র্যাক্টের (মূত্রনালীর) দেয়ালে ব্যাকটেরিয়া, বিশেষ করে E. coli, আটকে যেতে বাধা দেয়। এর ফলে সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারলেও জীবাণু দীর্ঘস্থায়ীভাবে মূত্রনালীতে বসবাস করতে পারে না। এটি মূলত প্রতিরোধমূলক হিসেবে কার্যকর, তবে প্রাথমিক ইনফেকশনের সময় সহায়ক হিসেবেও কাজ করে।

৩. প্রস্রাব চেপে রাখবেন নাঃ ইউরিন ইনফেকশনের সময় বা যেকোনো স্বাভাবিক অবস্থাতেও প্রস্রাব চেপে রাখা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যখন প্রস্রাবের বোধ হয়, তখন দেরি না করে তা ত্যাগ করা উচিত। কারণ মূত্রনালীতে দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্রাব জমে থাকলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। মূত্র দীর্ঘ সময় জমে থাকলে E. coli বা অন্যান্য জীবাণু দ্রুত সংখ্যায় বাড়তে থাকে এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এটি একটি ছোট অভ্যাস হলেও ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধের একটি বড় ধাপ। তাই যত দ্রুত সম্ভব প্রস্রাব ত্যাগ করার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।

৪. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুনঃ ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রস্রাব ও মল ত্যাগের পর সঠিকভাবে পরিষ্কার না করা হলে E. coli সহ বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালীতে প্রবেশ করতে পারে, যা সংক্রমণের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে নারীদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মলদ্বার ও মূত্রনালী একে অপরের খুব কাছাকাছি থাকায়, ভুল দিকে পরিষ্কার করলে মলদ্বারের ব্যাকটেরিয়া ইউরেথ্রায় চলে যেতে পারে। ঘাম ও আর্দ্রতা ধরে রাখে না এমন কাপড় পরে থাকলে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি কমে। প্রতিদিন অন্তর্বাস বদলানো উচিত।  তাই প্রতিদিনের জীবনে এই নিয়মগুলো মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।

৫. ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খানঃ ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে ও নিরাময়ে ভিটামিন সি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন আমলকি, লেবু, কমলা, বাতাবি লেবু, আনারস, টমেটো ইত্যাদি নিয়মিত খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই সহজ হয়। ভিটামিন সি ইউরিনের pH লেভেল কমিয়ে একে বেশি অ্যাসিডিক করে তোলে, যার ফলে ব্যাকটেরিয়া সহজে বেঁচে থাকতে পারে না। এতে ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়।ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা দেহকে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল ও সংক্রমণ সৃষ্টিকারী উপাদান থেকে রক্ষা করে।

৬. মসলাযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার না খাওয়াঃ ইউরিন ইনফেকশনের সময় মসলাযুক্ত, তেলেভাজা ও ঝাল খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরি। এই ধরনের খাবার শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং মূত্রনালীতে জ্বালাপোড়া ও অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে তোলে। অতিরিক্ত ঝাল বা মশলার কারণে ইউরিনে অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে তা বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে, যা ব্যাকটেরিয়ার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। এই সময় পাকস্থলী দুর্বল থাকে। ভাজাপোড়া ও তেলযুক্ত খাবার হজমে সমস্যা করে, শরীর দুর্বল করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

৭. সবুজ শাকসবজি, ফলমূল বেশি করে খাওয়াঃ ইউরিন ইনফেকশন দূর করতে এবং শরীরের স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া অত্যন্ত উপকারী। এই ধরনের খাবারে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পানি, যা শরীরকে ভিতর থেকে পরিষ্কার রাখতে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে সহায়তা করে। ফলমূল ও শাকসবজিতে থাকা ভিটামিন সি, এ, কে এবং জিঙ্ক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, যা ইউরিন ইনফেকশন থেকে সেরে উঠতে সাহায্য করে। অনেক শাকসবজি ও ফলে পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট থাকে যা ইউরিনের মাধ্যমে টক্সিন ও ব্যাকটেরিয়া শরীর থেকে বের করতে সাহায্য করে।

৮. ডাব অথবা নারকেলের পানি পান করাঃ ইউরিন ইনফেকশন থেকে দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে চাইলে ডাবের পানি এক অসাধারণ প্রাকৃতিক পানীয়। এটি শুধু শরীর ঠান্ডা রাখে না, বরং শরীর থেকে ব্যাকটেরিয়া দূর করতে এবং মূত্রনালী পরিষ্কার রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। ডাবের পানি মূত্রবর্ধক হিসেবে কাজ করে, অর্থাৎ এটি ঘন ঘন প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়ায়। এর ফলে মূত্রনালীর মধ্যে জমে থাকা জীবাণু ও টক্সিন সহজেই বের হয়ে যায়। ইউরিন ইনফেকশনের সময় শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পানিশূন্যতা দেখা দেয়। ডাবের পানিতে থাকা পটাশিয়াম, সোডিয়াম ও অন্যান্য খনিজ উপাদান শরীরে জলীয় ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৯. ধনিয়া, মেথি বা অন্যান্য ভেষজ পানি পান করাঃ ইউরিন ইনফেকশন দূর করতে প্রাচীনকাল থেকে ধনিয়া, মেথি ও অন্যান্য ভেষজ উপাদান পানি রূপে সেবন করে আসা হচ্ছে। এসব ভেষজ উপাদান শরীরকে ডিটক্সিফাই করে, মূত্রনালী পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ধনিয়াতে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান, যা ইউরিন ইনফেকশনের জীবাণু দমন করে। ধনিয়া পানি ডায়ুরেটিক হিসেবে কাজ করে, প্রস্রাব বাড়ায় এবং ব্যাকটেরিয়া ধুয়ে যেতে সাহায্য করে। মেথি বীজে রয়েছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ও প্রদাহনাশক গুণ। এটি প্রস্রাবের সংক্রমণে অস্বস্তি ও জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে।

১০. চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াঃ ইউরিন ইনফেকশন সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু ঘরোয়া উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও, উপসর্গ যদি তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে অবহেলা না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ অনেক সময় সংক্রমণ শুধু মূত্রথলি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না থেকে কিডনিতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা বিপজ্জনক। ইউরিন ইনফেকশন সাধারণত Escherichia coli (E. coli) ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়, যা শরীর থেকে পুরোপুরি দূর করতে অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্য প্রয়োজন। চিকিৎসক ইউরিন কালচার টেস্ট করে ব্যাকটেরিয়ার ধরন অনুযায়ী ওষুধ নির্ধারণ করেন, যা সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ পদ্ধতি।

ইউরিন ইনফেকশনের কারণ

ইউরিন ইনফেকশনের কারণ হলো ব্যাকটেরিয়া। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দায়ী ব্যাকটেরিয়ার নাম Escherichia coli (E. coli), যা আমাদের অন্ত্রে স্বাভাবিকভাবে বাস করে। কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়া যখন মলদ্বারের আশেপাশ থেকে মূত্রনালীতে প্রবেশ করে এবং সেখানে বংশবৃদ্ধি করে, তখনই ইউরিন ইনফেকশন দেখা দেয়। তবে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, অভ্যাস, শারীরিক অবস্থা এবং কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতি এই সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। বিস্তারিত নিচেঃ
১. E. coli ব্যাকটেরিয়াঃ Escherichia coli (E. coli) একটি সাধারণ ব্যাকটেরিয়া, যা স্বাভাবিকভাবে মানুষের অন্ত্রে বাস করে এবং হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। যদিও এটি অন্ত্রে উপকারী হিসেবে বিবেচিত, তবে যখন এটি পায়ুপথের কাছাকাছি থেকে ইউরেথ্রা (মূত্রনালী) দিয়ে মূত্রথলিতে প্রবেশ করে, তখন তা ইউরিন ইনফেকশন বা মূত্রনালীর সংক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। E. coli সাধারণত মলদ্বারের চারপাশে থাকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখলে কিংবা ভুলভাবে মলত্যাগের পর পরিষ্কার করলে এই ব্যাকটেরিয়া ইউরেথ্রায় প্রবেশ করতে পারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে এই ব্যাকটেরিয়া ইউরেথ্রা দিয়ে মূত্রথলিতে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়।

২. পর্যাপ্ত পানি না পান করাঃ ইউরিন ইনফেকশনের অন্যতম সাধারণ কারণ হলো পর্যাপ্ত পানি না পান করা। শরীরে যখন পানি কম থাকে, তখন প্রস্রাবের পরিমাণও কমে যায়। ফলে প্রস্রাবের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে যেসব ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালী থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা, সেগুলো শরীরেই থেকে যায় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। পানি কম খেলে প্রস্রাব ঘন ঘন হয় না, ফলে ব্যাকটেরিয়া জমে থাকতে পারে। ঘন ও গাঢ় প্রস্রাবে ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। প্রস্রাবে পর্যাপ্ত প্রবাহ না থাকলে মূত্রনালী ভালোভাবে পরিষ্কার হয় না, যা ইনফেকশনের সুযোগ তৈরি করে।

৩. প্রস্রাব চেপে রাখাঃ দীর্ঘ সময় প্রস্রাব চেপে রাখা ইউরিন ইনফেকশনের একটি অন্যতম কারণ। যখন প্রস্রাব দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রাখা হয়, তখন মূত্রথলিতে ব্যাকটেরিয়া জমে সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত প্রস্রাবের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া শরীর থেকে বেরিয়ে যায়, কিন্তু চেপে রাখার কারণে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। মূত্র দীর্ঘক্ষণ জমে থাকলে ব্যাকটেরিয়া সহজে বংশবৃদ্ধি করে এবং সংক্রমণের জন্য অনুকূল পরিবেশ পায়। চেপে রাখা প্রস্রাব মূত্রথলির দেয়ালে চাপ সৃষ্টি করে, এতে প্রদাহ বা জ্বালাপোড়া হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি কিডনির দিকেও সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে।

৪. অপরিষ্কার টয়লেট ব্যবহারঃ অপরিষ্কার টয়লেট, বিশেষ করে পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের মাধ্যমে ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে যায়। এই ধরনের টয়লেটে সাধারণত বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু মলমূত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে, যেগুলো সরাসরি মূত্রনালীতে প্রবেশ করে সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। অপরিষ্কার কমোড বা টয়লেট সিটে বসার ফলে পায়ুপথ বা যৌনাঙ্গে জীবাণু লেগে যায়, যা পরে ইউরেথ্রা দিয়ে প্রবেশ করে। টয়লেটের ফ্লাশ, দরজার হ্যান্ডেল বা পানির মগও জীবাণুর বাহক হতে পারে। নারীদের ইউরেথ্রা ছোট হওয়ায় ও পায়ুর কাছাকাছি অবস্থান করায় সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে।

৫. যৌনক্রিয়াঃ ইউরিন ইনফেকশনের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো যৌনসম্পর্কের সময় ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ। যৌনক্রিয়াকালে বিশেষ করে পায়ুপথের আশেপাশে থাকা ব্যাকটেরিয়া, যেমন E. coli, সহজেই ইউরেথ্রা (মূত্রনালী) দিয়ে মূত্রথলিতে প্রবেশ করতে পারে, যা ইউরিন ইনফেকশন সৃষ্টি করে। যৌনমিলনের সময় ত্বকের ঘর্ষণ ও চাপের ফলে ব্যাকটেরিয়া ইউরেথ্রার ভেতর ঢুকে যেতে পারে। যদি যৌনক্রিয়ার আগে বা পরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখা হয়, তাহলে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। নারীদের ইউরেথ্রা ছোট এবং পায়ুর কাছাকাছি থাকায়, এই ব্যাকটেরিয়া সহজেই ভিতরে প্রবেশ করতে পারে।

৬.ক্যাথেটার ব্যবহারঃ দীর্ঘদিন ধরে ইউরিন ক্যাথেটার ব্যবহারের ফলে ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। ক্যাথেটার হলো একটি নরম নল, যা প্রস্রাব বের করতে মূত্রথলিতে স্থাপন করা হয়। তবে এটি ব্যবহারে বাইরের জীবাণু খুব সহজেই মূত্রনালীতে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ক্যাথেটার সরাসরি মূত্রথলিতে স্থাপন করা হয়, যা জীবাণুর সরাসরি প্রবেশ পথ তৈরি করে। দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে নলের চারপাশে ব্যাকটেরিয়া জমে যায় এবং মূত্রথলিতে পৌঁছে সংক্রমণ ঘটায়। যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা না মানা হয়, তাহলে সংক্রমণের আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।

৭. ডায়াবেটিস বা দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাঃ যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে বা যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এই অবস্থায় শরীর সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাভাবিকভাবে যতটা সক্রিয় থাকে, তা আর হয় না। ফলে সামান্য ব্যাকটেরিয়া ঢুকলেই তা সহজে মূত্রনালীতে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ (চিনি) থাকায় ব্যাকটেরিয়া সহজে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। ডায়াবেটিসে অনেক সময় প্রস্রাবের প্রবাহ দুর্বল হয়, ফলে ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালীতে জমে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিসে স্নায়ু দুর্বল হয়ে যায়, ফলে প্রস্রাবের চাপ অনুভব না হওয়ায় চেপে রাখার প্রবণতা বাড়ে।

৮. নারীদের অঙ্গ গঠনের কারণেঃ নারীদের শারীরিক গঠনগত কারণে ইউরিন ইনফেকশনের আশঙ্কা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। এর মূল কারণ হলো মূত্রনালী ছোট এবং পায়ুর খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। ফলে ব্যাকটেরিয়া বিশেষ করে E. coli খুব সহজে ইউরেথ্রা দিয়ে মূত্রথলিতে প্রবেশ করতে পারে। নারীদের ইউরেথ্রা প্রায় ১.৫ ইঞ্চি লম্বা, যা পুরুষদের ইউরেথ্রার চেয়ে অনেক ছোট। ছোট ইউরেথ্রা দিয়ে ব্যাকটেরিয়া সহজেই ও দ্রুত মূত্রথলিতে পৌঁছে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। মলদ্বার ও ইউরেথ্রার মুখ খুব কাছাকাছি হওয়ায় পায়ুপথে থাকা ব্যাকটেরিয়া সহজেই মূত্রনালীতে প্রবেশ করে। মাসিক চলাকালে সঠিক পরিচ্ছন্নতা না মানলে বা যৌনক্রিয়ার সময় জীবাণু প্রবেশের ঝুঁকি থাকে।

ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণসমূহ

ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষনসমূহকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এসব উপসর্গ চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিলে জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। ইউরিন ইনফেকশন বা মূত্রনালীর সংক্রমণ হলে শরীরে বেশ কিছু স্পষ্ট ও বিরক্তিকর উপসর্গ দেখা দেয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রাথমিক লক্ষণ হলো প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া অনুভব করা। তবে এটি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলে ইউরিন ইনফেকশন সহজে চিহ্নিত করা যায়।
১. প্রস্রাব করার সময় জ্বালাপোড়া বা ব্যথা অনুভব হওয়াঃ এটি ইউরিন ইনফেকশনের সবচেয়ে সাধারণ ও প্রাথমিক লক্ষণ। যখন মূত্রনালীতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে, তখন সেই অংশে প্রদাহ বা ফোলাভাব সৃষ্টি হয়। এই প্রদাহই মূলত প্রস্রাবের সময় তীব্র জ্বালাপোড়া, চুলকানি কিংবা খোঁচা খোঁচা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই ভাবেন এটি সাময়িক পানি কম পান করার কারণে হয়েছে, কিন্তু যদি ১–২ দিনের মধ্যে উপসর্গ না কমে, তাহলে তা ইনফেকশনের ইঙ্গিত হতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না করলে সংক্রমণ কিডনি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা অনেক বেশি জটিল ও বিপজ্জনক।

২. প্রস্রাবের পরও আবার প্রস্রাবের তীব্র বেগ অনুভব হওয়াঃ ইউরিন ইনফেকশনের আরেকটি পরিচিত ও বিরক্তিকর লক্ষণ হলো প্রস্রাব শেষ হওয়ার পরেও যেন প্রস্রাব বাকি আছে এমন অনুভূতি বা বারবার প্রস্রাবের তাগিদ। এটি সাধারণত মূত্রথলি বা মূত্রনালীর প্রদাহ বা সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। ইনফেকশনের কারণে মূত্রথলির দেয়ালে সংবেদনশীলতা বেড়ে যায়। এতে সামান্য প্রস্রাব থাকলেও মনে হয় অনেক বেগ রয়েছে। ইনফেকশনের কারণে মূত্রথলি বা ইউরেথ্রার প্রদাহ মস্তিষ্কে ভুল সংকেত পাঠায়, ফলে বারবার প্রস্রাবের বোধ হয় – যদিও বাস্তবে তা থাকে না।

৩. ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া বিশেষ করে রাতের বেলাঃ ইউরিন ইনফেকশনের অন্যতম লক্ষণ হলো দিন-রাত প্রায় বারবার প্রস্রাবের চাপ অনুভব করা, বিশেষ করে রাতে ঘুম থেকে উঠে বারবার প্রস্রাব করতে যাওয়া। এটিকে মেডিক্যাল টার্মে Nocturia বলা হয়। ব্যাকটেরিয়ার কারণে মূত্রনালীর অভ্যন্তরীণ প্রাচীর ফোলা ও সংবেদনশীল হয়ে যায়। ফলে মূত্রথলি অনেক কম পরিমাণে পূর্ণ হলেও বারবার প্রস্রাবের চাপ আসতে থাকে। অনেক সময় বেশি পানি পান করাও রাতে ঘুম ভেঙে প্রস্রাবের জন্য দায়ী হতে পারে, তবে ইউরিন ইনফেকশনের ক্ষেত্রে এটা মূল কারণ নয়।

৪. প্রস্রাবের রঙ ও গন্ধে পরিবর্তনঃ ইউরিন ইনফেকশনের একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হলো প্রস্রাবের রঙ ও গন্ধের পরিবর্তন হওয়া। সাধারণত সুস্থ মানুষের প্রস্রাব হালকা হলুদ বা পাতলা হয় এবং তেমন কোনো তীব্র গন্ধ থাকে না। কিন্তু সংক্রমণের কারণে প্রস্রাবের রং ও গন্ধ পরিবর্তিত হতে পারে, যা সংক্রমণের উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। প্রস্রাব ঘোলা বা ঝাঁঝালো হয়ে যেতে পারে, কারণ তাতে সংক্রমিত কোষ ও পুঁজ (pus) মিশে থাকে।মূত্রে রক্ত দেখা যেতে পারে, যা প্রস্রাবকে গোলাপি, লাল বা গাঢ় বাদামী রঙের করে তোলে। এটি সংক্রমণের গুরুতরতা বা ক্ষতচিহ্নের নির্দেশক হতে পারে। প্রস্রাবের গন্ধ তীব্র ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যেতে পারে, যেমন পচা বা ফাউল গন্ধ।

৫. পেটের নিচের অংশে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করাঃ ইউরিন ইনফেকশনের একটি সাধারণ ও প্রচলিত লক্ষণ হলো পেটের নিচের অংশে ব্যথা বা অস্বস্তি থাকা। মূত্রথলি (ব্লাডার) এবং আশেপাশের মাংসপেশীতে সংক্রমণের কারণে এই ধরনের ব্যথা বা চাপের অনুভূতি তৈরি হয়। সংক্রমণের কারণে মূত্রথলি ফুলে যাওয়ায় চাপ বৃদ্ধি পায়, যা পেটের নিচে অস্বস্তিকর বা তীব্র ব্যথার কারণ হতে পারে।কখনো ব্যথা চাপা বা ধারালো ধরনের হতে পারে, বিশেষ করে প্রস্রাবের সময় এই ব্যথা বেড়ে যায়।সংক্রমণ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, ব্যথাও দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র হতে পারে।

৬. হালকা জ্বর বা শরীরে দুর্বলতা অনুভব করাঃ ইউরিন ইনফেকশনের সময় শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক সময় শরীরে হালকা জ্বর, ঠান্ডা লাগা এবং সাধারণ দুর্বলতার অনুভূতি দেখা দিতে পারে। এটি সংক্রমণের শারীরিক প্রতিক্রিয়ার অংশ।সংক্রমণের ফলে শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বেড়ে যায়, যা হালকা জ্বরের সৃষ্টি করে। ব্যাকটেরিয়া ও প্রদাহজনিত রাসায়নিক পদার্থ শরীরের কোষগুলোকে দুর্বল করে তোলে। এ কারণে শরীরের শক্তি কমে যায়, ফলে ক্লান্তি ও অজীব অনুভূতি দেখা দেয়।

৭. কোমর বা পিঠ ব্যথা করাঃ ইউরিন ইনফেকশন কখনো কখনো কিডনি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লে কোমর বা পিঠে ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে। এটি সংক্রমণের একটি গুরুতর লক্ষণ এবং দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।ইউরিন ইনফেকশন সাধারণত মূত্রনালী বা মূত্রথলিতে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে যদি সংক্রমণ কিডনি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, তখন কিডনির আশেপাশের টিস্যুতে প্রদাহ হয়। এই প্রদাহ ও চাপের কারণে কোমর বা পিঠের একপাশে বা উভয় পাশে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। অনেক সময় জ্বর, শীতল কাঁপুনি ও বমিও এই অবস্থার সঙ্গে থাকতে পারে।

৮. শিশুদের ক্ষেত্রে জ্বর, খাওয়ায় অনীহা বা মেজাজ খিটখিটে হওয়াঃ ইউরিন ইনফেকশন শিশুদের মধ্যে একটু ভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে পারে। ছোট শিশু ও নবজাতকেরা স্পষ্টভাবে তাদের সমস্যার কথা বলতে না পারায়, ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণগুলো মাঝে মাঝে ধরা কঠিন হতে পারে। এর ফলে জ্বর, অসুস্থতা ও অস্বস্তির কারণে শিশুরা খেতে চায় না বা খাবারে আগ্রহ হারায়। অস্বস্তি, ব্যথা এবং অসুস্থতার কারণে শিশুরা সাধারণত অতিরিক্ত রাগী, কাঁদু বা অস্থির হতে পারে।

ইউরিন ইনফেকশনে কারা বেশি ঝুঁকিতে?

ইউরিন ইনফেকশনের ঝুকিতে যেকোনো বয়স বা লিঙ্গের মানুষ থাকতে পারে। তবে নারীদের মধ্যে এর ঝুঁকি তুলনামূলক অনেক বেশি, কারণ তাদের মূত্রনালী ছোট এবং মলদ্বারের কাছাকাছি অবস্থান করে। তাদের শারীরিক গঠন, স্বাস্থ্যঅবস্থা বা দৈনন্দিন অভ্যাসের কারণে সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ে। সময়মতো যত্ন ও সচেতনতা থাকলে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। ইউরিন ইনফেকশনে কারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে এ সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
ইউরিন-ইনফেকশনে-কারা-বেশি-ঝুঁকিতে
১. নারীরাঃ নারীদের ইউরেথ্রা (মূত্রনালী) পুরুষদের তুলনায় ছোট এবং পায়ুর খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে E. coli ব্যাকটেরিয়া সহজেই ইউরেথ্রার মাধ্যমে মূত্রথলিতে প্রবেশ করতে পারে, যা ইউরিন ইনফেকশনের প্রধান কারণ। যৌনক্রিয়ার পর, গর্ভাবস্থায়, কিংবা মাসিক চলাকালে পরিচ্ছন্নতা না মানলে ঝুঁকি আরও বাড়ে। নারীদের শারীরিক গঠন ও জীবনীশক্তির কারণে তারা ইউরিন ইনফেকশনের জন্য বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
২. গর্ভবতী নারীঃ গর্ভবতী নারীরা ইউরিন ইনফেকশনের জন্য বিশেষভাবে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। কারণ, গর্ভে শিশুর বৃদ্ধি হওয়ায় মূত্রথলি ও মূত্রনালির ওপর চাপ পড়ে। এতে মূত্র সঠিকভাবে বের হতে পারে না, ফলে মূত্র থেমে থাকে এবং ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়। গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মূত্রনালির মসৃণ পেশি শিথিল হয়ে যায়, যা মূত্র প্রবাহ কমিয়ে দেয়। অনেক গর্ভবতী নারী প্রস্রাব চেপে রাখেন বা ঠিক মতো প্রস্রাব ত্যাগ করতে পারেন না, যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।a\z

৩. শিশুরা বিশেষ করে মেয়ে শিশুঃ শিশুরা, বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বেশি থাকে। মেয়ে শিশুর ইউরেথ্রা ছোট এবং মলদ্বারের কাছাকাছি অবস্থান করে, যা ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ সহজ করে তোলে। শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং পরিচ্ছন্নতার অভাবে ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বেশি থাকে। যদি ডায়াপার খুব বেশি সময় ধরে বদলানো না হয় বা সঠিকভাবে পরিষ্কার না করা হয়, তাহলে জীবাণু মূত্রনালীতে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

৪. বয়স্ক ব্যক্তিরাঃ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিবর্তন এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অবনতির কারণে বয়স্ক ব্যক্তিদের ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এসময় শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যায়, যার ফলে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শরীর কম সক্ষম হয়। বয়স বাড়ার কারণে মূত্রথলির পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে প্রস্রাব আটকে রাখা বা সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ না করার সমস্যা দেখা দেয়। এই অবস্থায় মূত্র থেমে থেকে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির সুযোগ পায়।

৫. ডায়াবেটিস রোগীরাঃ ডায়াবেটিস রোগীরা ইউরিন ইনফেকশনের জন্য বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। এর প্রধান কারণ হলো রক্তে উচ্চমাত্রায় শর্করা (গ্লুকোজ) এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ থাকার কারণে ব্যাকটেরিয়া সহজেই বৃদ্ধি পায় এবং দ্রুত সংক্রমণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। ডায়াবেটিসে শরীরের ইমিউন সিস্টেম কমজোর হয়ে পড়ে, ফলে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে না। ডায়াবেটিসের কারণে মূত্রনালির পেশিতে সমস্যা হতে পারে, যার ফলে প্রস্রাব ঠিকমতো হয় না বা আটকে থাকে।

৬. যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বলঃ কিছু ব্যক্তির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) দুর্বল থাকে, যার ফলে তারা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন না। এর ফলে ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ক্যান্সার রোগী, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনকারী, HIV/AIDS রোগী ইত্যাদি। এদের শরীর ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে অক্ষম হয়। অন্যান্য অবস্থায় যেমন স্টেরয়েড ব্যবহারকারী, দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক অসুস্থতা থাকা ব্যক্তিরাও ঝুঁকিতে থাকেন।

৭. যারা বারবার প্রস্রাব চেপে রাখেনঃ প্রস্রাব চেপে রাখা অনেকেই অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেন, বিশেষ করে যখন বাইরে, কাজে ব্যস্ত বা পরিচ্ছন্ন টয়লেট খুঁজে পান না। কিন্তু এই অভ্যাস ধীরে ধীরে মূত্রনালী ও মূত্রথলির স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। প্রস্রাব মূত্রথলিতে দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকলে সেখানে E. coli সহ অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে। নিয়মিত ও সময়মতো প্রস্রাব না করলে মূত্রনালীতে জমে থাকা ব্যাকটেরিয়া বেরিয়ে যেতে পারে না, যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।

৮. যৌনজীবনে সক্রিয় ব্যক্তিঃ যৌনজীবনে সক্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যে ইউরিন ইনফেকশনের (UTI) ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। যৌন সম্পর্কের সময় মূত্রনালির মুখে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করার সম্ভাবনা থাকে, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। নারীদের ইউরেথ্রা ছোট এবং পায়ুর কাছাকাছি থাকায় যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে সংক্রমণের আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। যৌন সম্পর্কের আগে ও পরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা না রাখলে জীবাণুর প্রবেশের ঝুঁকি বাড়ে।

ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধের উপায়

ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধের উপায় খুব কঠিন নয়, প্রয়োজন শুধু কিছু সাধারণ অভ্যাস গড়ে তোলা এবং সতর্ক থাকা। এটি একটি পরিচিত ও যন্ত্রণাদায়ক স্বাস্থ্যসমস্যা, যা নারীদের মধ্যে বেশি হলেও পুরুষ ও শিশুরাও এর ঝুঁকিতে থাকে। মূত্রনালীতে ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ ও সংক্রমণের ফলে এই সমস্যা দেখা দেয়। তবে সঠিক সচেতনতা ও নিয়ম মেনে চললে ইউরিন ইনফেকশন সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

১. পর্যাপ্ত পানি পান করাঃ ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে প্রথম ও সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো পর্যাপ্ত পানি পান করা। দিনে অন্তত ৮–১০ গ্লাস (প্রায় ২–৩ লিটার) পানি পান করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পানি বেশি পান করলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, ফলে মূত্রথলিতে জমে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এতে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ করার সুযোগ পায় না। এটি ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর উপায়।

২. প্রস্রাব চেপে না রাখাঃ প্রস্রাবের বেগ পেলেই দেরি না করে ত্যাগ করা উচিত। অনেকেই ব্যস্ততা, বাইরে থাকা বা পরিষ্কার টয়লেটের অভাবে প্রস্রাব চেপে রাখেন। এটি ইউরিন ইনফেকশনের অন্যতম কারণ। কিন্তু এই ছোট অথচ অবহেলিত অভ্যাস ধীরে ধীরে ভয়ংকর সমস্যা ডেকে আনতে পারে, যার মধ্যে অন্যতম হলো ইউরিন ইনফেকশন (UTI)। দীর্ঘ সময় প্রস্রাব আটকে রাখলে ব্যাকটেরিয়া মূত্রথলিতে জমে বাড়তে থাকে, যা সংক্রমণের সৃষ্টি করে। তাই প্রস্রাবের বেগ অনুভব করলে যত দ্রুত সম্ভব ত্যাগ করা উচিত।

৩. যৌনসম্পর্কের পর প্রস্রাব করাঃ বিশেষ করে নারীদের জন্য যৌনসম্পর্কের পর প্রস্রাব করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যৌনক্রিয়ার সময় বাইরে থেকে বা পায়ুমুখের কাছাকাছি থাকা ব্যাকটেরিয়া সহজেই ইউরেথ্রার মাধ্যমে মূত্রনালীতে প্রবেশ করতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া ইউরিনারি ট্র্যাক্টে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। প্রস্রাব করলে এই ব্যাকটেরিয়া ধুয়ে বের হয়ে যায়। এতে করে ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি ও সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়।

৪. মলদ্বার ও যৌনাঙ্গ ভালোভাবে পরিষ্কার রাখাঃ ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা শুধু শরীরের বাইরের সৌন্দর্য রক্ষার জন্য নয়, বরং এটি ভেতরের সংক্রমণ থেকে শরীরকে সুরক্ষিত রাখার অন্যতম মাধ্যম। ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে মলদ্বার ও যৌনাঙ্গ পরিষ্কার রাখা একটি প্রধান উপাদান। প্রস্রাব বা মল ত্যাগের পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে মুছতে হবে, যেন পায়ুপথের ব্যাকটেরিয়া ইউরেথ্রায় না পৌঁছে। প্রতিদিন গোসল এবং অন্তর্বাস পরিবর্তন করাও অপরিহার্য।

৫. পরিষ্কার ও শুকনো অন্তর্বাস ব্যবহারঃ অনেকেই জানেন না যে দৈনন্দিন পোশাকের একটি সাধারণ অংশ "অন্তর্বাস" মূত্রনালির সংক্রমণ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গোপন অঙ্গের স্বাস্থ্যের সাথে অন্তর্বাসের পরিচ্ছন্নতা ও কাপড়ের ধরন সরাসরি জড়িত। ভেজা বা ঘামে ভেজা অন্তর্বাস দীর্ঘ সময় পরে থাকলে সংক্রমণের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়। তাই সবসময় পরিষ্কার, শুষ্ক ও তুলার তৈরি অন্তর্বাস ব্যবহার করা উচিত। ভেজা অন্তর্বাস, টাইট পোশাক বা ঘামে ভেজা কাপড় দীর্ঘ সময় পরে থাকলে তা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

৬. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণঃ ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং বিভিন্ন সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ইউরিন ইনফেকশনের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে কার্যকর, কারণ এটি প্রস্রাবের স্বাভাবিক পিএইচ পরিবর্তন করে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির উপযোগী পরিবেশ নষ্ট করে দেয়। ভিটামিন সি শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রস্রাবকে অম্লীয় করে তোলে, যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধে সহায়ক। আমলকি, লেবু, কমলা, পেয়ারা, আনারস ইত্যাদি খাবার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত।

৭. চিনি ছাড়া ক্র্যানবেরি জুস পান করাঃ ক্র্যানবেরি জুস ইউরিন ইনফেকশনের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে যাদের বারবার ইউরিন ইনফেকশন হয়, তাদের জন্য এটি একটি স্বাভাবিক, নিরাপদ এবং ঘরোয়া প্রতিকার হতে পারে। ক্র্যানবেরিতে থাকে একটি বিশেষ প্রাকৃতিক যৌগ প্রোঅ্যান্থোসায়ানিডিন, যা Escherichia coli (E. coli) ব্যাকটেরিয়া আটকে যাওয়া রোধ করে, ফলে সংক্রমণ সহজে হয় না। এর ফলে ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালিতে বসবাস করতে পারে না এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে ধুয়ে বের হয়ে যায়।

৮. অতিরিক্ত গরম আবহাওয়ায় বেশি পানি খাওয়াঃ গ্রীষ্মকালে শরীর থেকে ঘামের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। এতে শরীর দ্রুত পানিশূন্য (ডিহাইড্রেটেড) হয়ে পড়ে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে প্রস্রাবের পরিমাণ ও গুণমানে। এই পরিস্থিতি ইউরিন ইনফেকশনের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। কম পানি খাওয়ায় ইউরিন ঘন হয়ে ওঠে, যা ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে।তাই গরমকালে আরও বেশি পরিমাণ পানি পান করা জরুরি। দিনে ৮–১২ গ্লাস (২–৩ লিটার) পানি পান করার চেষ্টা করুন।

৯. ডায়াপার ব্যবহারকারীদের বিশেষ যত্নঃ শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের অনেকে শারীরিক অসুবিধার কারণে নিয়মিত ডায়াপার ব্যবহার করে থাকেন। তবে দীর্ঘসময় একই ডায়াপার পরে থাকলে, কিংবা সঠিকভাবে পরিষ্কার না রাখলে তা ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে দেয়, যা ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। প্রস্রাব বা মল ত্যাগের পর ভেজা অবস্থায় ডায়াপার পরে থাকলে সেখানে তাপ ও আর্দ্রতার কারণে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত জন্ম নেয়। ভেজা ডায়াপার ত্বকে র‍্যাশ, লালচে ভাব বা ছত্রাক সৃষ্টি করতে পারে, যা সংক্রমণ আরও জটিল করে তোলে।

ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে ঘরোয়া উপায়

ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে ঘরোয়া উপায় দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইউরিন ইনফেকশন বা মূত্রনালির সংক্রমণ একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা নারী-পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। এটি মূলত ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে, যার মধ্যে E. coli ব্যাকটেরিয়া অন্যতম। যদিও চিকিৎসকরা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে এর চিকিৎসা করেন, তবে প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করে সহজেই এই সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।
১. পর্যাপ্ত পানি পান করুনঃ ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী ঘরোয়া উপায় হল পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা। দিনে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করলে শরীর থেকে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, যা মূত্রনালিতে জমে থাকা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে ধুয়ে বের করে দেয়। পানি প্রস্রাবকে পাতলা করে, ফলে ইউরিনের মধ্যে অ্যাসিড ও ইউরিয়ার পরিমাণ কমে যায়, যা জ্বালাপোড়া বা অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে। তাই সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার জন্য নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি।

২. ক্র্যানবেরি জুস পান করুনঃ ক্র্যানবেরি জুসে থাকে প্রোঅ্যান্থোসায়ানিডিনস নামক একটি বিশেষ উপাদান, যা মূত্রনালির দেয়ালে ব্যাকটেরিয়ার আটকে যাওয়া রোধ করে। এর ফলে ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালিতে সংক্রমণ ছড়াতে পারে না। নিয়মিত চিনি ছাড়া (unsweetened) ক্র্যানবেরি জুস পান করলে ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে সাহায্য পাওয়া যায়। তবে অতিরিক্ত চিনি যুক্ত ক্র্যানবেরি জুস এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ চিনি ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বাড়িয়ে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

৩. গরম পানির সেঁক দিনঃ ইউরিন ইনফেকশনের সময় অনেকেই পেটের নিচের অংশে চাপ বা ব্যথা অনুভব করেন। এই ব্যথা কমাতে হালকা গরম পানির ব্যাগ ব্যবহার খুবই উপকারী। গরম সেঁক রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, ফলে ব্যথা কিছুটা লাঘব পায়। তবে সেঁক খুব গরম না করে, সহনীয় মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। দিনে ২ থেকে ৩ বার, প্রতিবার ১০ থেকে ১৫ মিনিট গরম সেঁক দিতে পারেন।

৪. ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুনঃ ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্রাব বা মল ত্যাগের পর ভালোভাবে পরিষ্কার হওয়া উচিত। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে মুছতে হবে, যাতে মলদ্বারের ব্যাকটেরিয়া ইউরেথ্রায় পৌঁছাতে না পারে। এছাড়াও, প্রতিদিন পরিষ্কার ও শুকনো অন্তর্বাস পরা জরুরি। যৌনসম্পর্কের পর দ্রুত প্রস্রাব ত্যাগ করাও সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। সুতরাং, নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ইনফেকশন প্রতিরোধে সহায়ক।

৫. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খানঃ ভিটামিন সি প্রস্রাবকে অম্লীয় করে তোলে, যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এছাড়া, ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়, ফলে ইউরিন ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়াই আরও শক্তিশালী হয়। এটি শরীরের ইমিউন সিস্টেম সক্রিয় করে তুলেও সংক্রমণ ঠেকাতে সাহায্য করে। আমলকি, লেবু, কমলা, পেয়ারা, আনারস ইত্যাদি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল নিয়মিত খাওয়া উচিত, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।

৬. প্রস্রাব চেপে না রাখাঃ অনেকে কাজের ব্যস্ততা বা বাইরে পরিষ্কার টয়লেট না পাওয়ার কারণে প্রস্রাব চেপে রাখেন, যা একটি বড় ভুল। দীর্ঘ সময় প্রস্রাব আটকে রাখলে মূত্রথলিতে ব্যাকটেরিয়ার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে, যা ইউরিন ইনফেকশনের প্রধান কারণ। এছাড়া, দীর্ঘ সময় চাপ থাকার ফলে মূত্রনালির পেশিও দুর্বল হয়ে যেতে পারে, যা প্রস্রাব ত্যাগে সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই প্রস্রাব করার তীব্র বেগ অনুভব করলেই দেরি না করে তা ত্যাগ করা উচিত।

ইউরিন ইনফেকশন হলে যেসকল খাবার খাওয়া যাবে না

ইউরিন ইনফেকশন হলে কিছু খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এগুলো সংক্রমণের উপসর্গ বাড়িয়ে দিতে পারে অথবা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি সহজতর করে। সঠিক খাবার যেমন রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে ঠিক তেমনি ভুল খাবার সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী করে ও শরীরকে আরও দুর্বল করে দেয়। তাই ইউরিন ইনফেকশনের সময় শুধু কি খাবেন তা জানার পাশাপাশি কি খাবেন না সেটিও জানা অনেক গুরুত্বপূর্ন। নিচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলোঃ

  • অতিরিক্ত ঝাল ও মসলা যুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। অতিরিক্ত মরিচ, লঙ্কা, বা ঝালমশলা যুক্ত খাবার মূত্রথলির প্রদাহ বাড়াতে পারে। এতে প্রস্রাবের সময় ব্যথা ও জ্বালাপোড়া তীব্র হয়।
  • ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন চা, কফি, সফট ড্রিংক ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে হবে। ক্যাফেইন প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়ায় এবং মূত্রনালিকে উত্তেজিত করতে পারে, ফলে জ্বালাপোড়া ও ব্যথা আরও বাড়ে।
  • অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার যেমন চানাচুর, চিপস, প্রক্রিয়াজাত শুকনো স্ন্যাকস, প্যাকেটজাত খাবার ইত্যাদি খাওয়া উচিত নয়। এই খাবারগুলিতে সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে, যা শরীরে পানিশূন্যতা (dehydration) সৃষ্টি করতে পারে।
  • অ্যাসিডযুক্ত ফল যেমন টমেটো, আনারস, কমলা, লেবু ইত্যাদি অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না। যদিও ভিটামিন সি উপকারী, তবে অতিরিক্ত অ্যাসিডযুক্ত ফল ইউরিনের জ্বালাপোড়া বাড়াতে পারে।
  • মদ ও অ্যালকোহলজাতীয় পানীয় ভুলেও পান করা যাবে না। অ্যালকোহল ডিহাইড্রেশন তৈরি করে এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়। এটি মূত্রথলি ও ইউরেথ্রা আরো সংবেদনশীল করে তোলে।
  • ফাস্টফুড যেমন বার্গার, পিৎজা, সসেজ ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে হবে। এই ধরনের খাবারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে, যা দেহে প্রদাহ বাড়ায় এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে।অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার বা ডেজার্ট জাতীয় খাবার, কেক, মিষ্টি, চকলেট বা মিষ্টি জুস এড়িয়ে চলা উচিত। অতিরিক্ত চিনি ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
  • অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ যেমন গরু বা খাসির মাংস, ভাজা ডিম, এবং অতিরিক্ত পরিমাণ মাছ বা মুরগি, কিডনির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। শরীর যখন অতিরিক্ত প্রোটিন ভাঙে, তখন ইউরিনে ইউরিয়া ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থের মাত্রা বেড়ে যায়।
  • কৃত্রিম রঙ যুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। এই ধরনের খাবার যেমন রঙিন মিষ্টি, আইসক্রিম, জেলি, প্যাকেটজাত পানীয়, চিপস বা বেকারি পণ্য প্রস্রাবকে উত্তেজিত করে এবং সংক্রমণের উপসর্গ বাড়িয়ে দিতে পারে।
  • ঠান্ডা পানীয় ও আইসক্রিম জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না। কারণ এইসব খাবার শরীরকে সাময়িকভাবে শীতল করলেও এতে থাকে উচ্চমাত্রার চিনি, কৃত্রিম রঙ, সংরক্ষণকারী কেমিক্যাল ও ক্যাফেইন, যা মূত্রথলিকে উত্তেজিত করে এবং সংক্রমণের উপসর্গ আরও বাড়িয়ে তোলে।

ইউরিন ইনফেকশনের চিকিৎসা

ইউরিন ইনফেকশন হলে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হলো ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা। অনেকেই শুরুতে ঘরোয়া উপায়ে উপশম পাওয়ার চেষ্টা করেন, তবে সংক্রমণের মাত্রা বেশি হলে তা অকার্যকর হতে পারে এবং সমস্যা আরও বেড়ে যায়। চিকিৎসক রোগীর উপসর্গ ও ইউরিন পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধ নির্ধারণ করে থাকেন। সাধারণত ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করলে উপসর্গ অনেকটাই কমে যায়।
ইউরিন-ইনফেকশনের-চিকিৎসা
তবে মনে রাখতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা উচিত নয়, এবং সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করা অত্যন্ত জরুরি। কোর্স অসম্পূর্ণ রাখলে সংক্রমণ আবার ফিরে আসতে পারে এবং অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (যেখানে ব্যাকটেরিয়া ওষুধে আর সাড়া দেয় না) তৈরি হতে পারে, যা ভবিষ্যতে আরও বিপজ্জনক। যদি ইউরিন ইনফেকশন চিকিৎসা না করা হয় বা অবহেলা করা হয়, তাহলে সংক্রমণ ধীরে ধীরে মূত্রথলি (bladder) পেরিয়ে কিডনিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এ অবস্থাকে বলা হয় pyelonephritis, যা জ্বর, কোমর ব্যথা, বমি এমনকি কিডনি ক্ষতির মতো গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে পারে। এগুলো একেকটি জরুরি চিকিৎসার বিষয় এবং অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি হতে হতে পারে। ইউরিন ইনফেকশন একটি সাধারণ সমস্যা হলেও যথাযথ চিকিৎসা ছাড়া তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। তাই দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করাই সর্বোত্তম সমাধান।

শেষ কথাঃ ইউরিন ইনফেকশন দূর করার উপায়

ইউরিন ইনফেকশন দূর করার উপায় সম্পর্কে ইতিমধ্য আমি উপরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।ইউরিন ইনফেকশন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি প্রচলিত স্বাস্থ্যসমস্যা, যা সচেতন না হলে বড় ধরণের জটিলতায় পরিণত হতে পারে। অনেকেই প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে অবহেলা করে থাকেন, ফলে সংক্রমণ ধীরে ধীরে কিডনিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং জ্বর, কোমর ব্যথা, এমনকি কিডনি ক্ষতির মতো গুরুতর সমস্যা তৈরি করে।

আমার মতে, ইউরিন ইনফেকশন দূর করার ক্ষেত্রে চিকিৎসা এবং দৈনন্দিন অভ্যাস দুটোই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ অবশ্যই প্রয়োজন, তবে শুধু ওষুধেই নির্ভরশীল হলে চলবে না। বরং ঘরোয়া যত্ন যেমন পর্যাপ্ত পানি পান, প্রস্রাব চেপে না রাখা, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া ইত্যাদি এই অভ্যাসগুলো সংক্রমণ প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর।

বর্তমান জীবনযাত্রায় বাইরে থাকা, ব্যস্ততা, দূষণ, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস এবং টয়লেট ব্যবহারে অসচেতনতার কারণে ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। তাই আমার মতে, এই সমস্যার সমাধান কেবল চিকিৎসা নয়, সচেতনতা এবং প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিবর্তনই আসল চাবিকাঠি। আর প্রতিদিন কিছু সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে শুধু ইউরিন ইনফেকশন নয়, আরও অনেক রোগ থেকে সহজেই মুক্ত থাকা সম্ভব।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url