রাজশাহীর বিখ্যাত আমের তালিকা

রাজশাহীর বিখ্যাত আমের তালিকা বা জনপ্রিয় আমের জাত সম্পর্কে জানতে পারবেন এই পোস্টে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা রাজশাহী শুধু তার শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং আমের অতুলনীয় স্বাদের জন্যও বিখ্যাত। আমের রাজ্য নামে খ্যাত রাজশাহীর এই ফল আজ দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও জায়গা করে নিয়েছে।
রাজশাহীর-বিখ্যাত-আমের-তালিকা
রাজশাহীতে আমচাষের ঐতিহ্য শত শত বছর পুরোনো। মুঘল আমলে রাজশাহী অঞ্চলের জমিদাররা আমবাগান করতেন তাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য এবং উপঢৌকন হিসেবে নবাব বা বাদশার কাছে পাঠাতেন। ব্রিটিশ আমলেও এই অঞ্চলের আম বিশেষভাবে সমাদৃত ছিল। ধারণা করা হয়, ফজলি ও ল্যাংড়া জাতের আম সেই সময়েই জনপ্রিয়তা পায়।

পোস্ট সূচিপত্রঃ রাজশাহীর বিখ্যাত আমের তালিকা

রাজশাহী কেনো আমের রাজ্য হিসেবে খ্যাত

রাজশাহী কেনো আমের রাজ্য হিসেবে খ্যাত, কারণ এই অঞ্চলে বাংলাদেশের সর্বাধিক এবং উৎকৃষ্ট মানের আম উৎপাদিত হয়। রাজশাহীকে ‘আমের রাজ্য’ বলা হয় একাধিক কারণের ভিত্তিতে, রাজশাহীর মাটি মূলত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ প্রকৃতির, যা আম গাছের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এ ছাড়াও দীর্ঘ গ্রীষ্মকাল, পর্যাপ্ত রোদ, তুলনামূলকভাবে কম বৃষ্টিপাত, উঁচু জমি (বরেন্দ্র অঞ্চল), এসব বিষয় আম চাষের জন্য সহায়ক।
এই আবহাওয়া আমকে মিষ্টি ও রসালো করে তোলে এবং অন্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি সময় ধরে সংরক্ষণযোগ্য রাখে। রাজশাহীতে প্রায় ২৫+ জাতের আম চাষ হয়, এখানে উৎপাদিত কিছু বিখ্যাত আমের জাত যেমন- ল্যাংড়া, হিমসাগর (ক্ষিরসাপাত), ফজলি, গোপালভোগ, আশ্বিনা, আম্রপালি ইত্যাদি। এই সব জাত দেশজুড়ে এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও জনপ্রিয়। রাজশাহী অঞ্চলের আম সুস্বাদু, রসাল ও স্বাভাবিকভাবে পাকানো বলে এর কদর বেশি।

প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে আমের মৌসুমে রাজশাহীতে আমের বিশাল বাজার ও মেলা বসে, যা কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট আমের প্রায় ২৫-৩০% রাজশাহী অঞ্চল থেকে আসে। প্রতি বছর এখানে লক্ষাধিক মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়। প্রতি বছর “আম উৎসব” হয় রাজশাহীতে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা মে-জুন মাসে এই অঞ্চলে ঘুরতে আসেন শুধু আম খাওয়ার অভিজ্ঞতার জন্য।

বিভিন্ন খামারে "Pick Your Own Mango" পর্যটন চালু হয়েছে, যেখানে পর্যটক নিজের হাতে আম পাড়তে পারেন। রাজশাহীর হিমসাগর, আম্রপালি ও ফজলি আম মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয়। উৎপাদন, মান, জাতের বৈচিত্র্য, ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে বিচার করলে রাজশাহীর মত আর কোনো অঞ্চল এতদূর বিস্তৃতভাবে আম চাষে এগিয়ে নেই। এই কারণেই “রাজশাহী” শুধু একটি জেলা নয়, এটি বাংলাদেশের ‘আমের রাজধানী’ বা ‘আমের রাজ্য’ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

রাজশাহীর বিখ্যাত আমের তালিকা

রাজশাহীর বিখ্যাত আমের তালিকা নিচে দেওয়া হলো, যেগুলো স্বাদ, গুণগত মান ও জনপ্রিয়তার দিক থেকে দেশের সেরা হিসেবে বিবেচিত। রাজশাহী অঞ্চলের বিশেষ করে গোদাগাড়ী, পুঠিয়া, দূর্গাপুর, চারঘাট, বাঘা, এবং আশপাশের উপজেলাগুলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত আম উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এখানকার মাটি ও জলবায়ু এতটাই উপযোগী যে, এখানেই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সুস্বাদু আমের জাতগুলোর বিকাশ লাভ করেছে।

আমের নাম বৈশিষ্ট্য পাকার সময়
হিমসাগর (ক্ষিরসাপাত) আঁশবিহীন, খুব মিষ্টি, ঘ্রাণযুক্ত, রপ্তানিযোগ্য মে মাসের শেষ–জুনের শুরু
ল্যাংড়া পাতলা খোসা, সুগন্ধী, আঁশ কম জুনের মাঝামাঝি
ফজলি আকারে বড়, হালকা মিষ্টি, দেরিতে পাকে সংরক্ষণযোগ্য, প্রক্রিয়াজাতকরণে ভালো জুলাই মাস
আম্রপালি হাইব্রিড জাত, খুব মিষ্টি, ছোট আকৃতির জুনের শেষ–জুলাই
গোপালভোগ খোসা পাতলা, রসালো, সুগন্ধযুক্ত, মৌসুমের প্রথম আম জুন মাস
মোহনভোগ তুলনামূলক কম পাওয়া যায়, সুস্বাদু জুন মাস
লক্ষনভোগ (লখনা) আঁশ খুবই কম,অতুলনীয় মিষ্টি স্বাদযুক্ত, রং ও গন্ধ অসাধারন, খোসা পাতলা ও আটি পাতলা। জুন মাসের মাঝামাঝি
সুরমা ফজলি ফজলির মতো কিন্তু সুগন্ধ বেশি জুলাই মাস
রাণিপছন্দ মিষ্টি, নরম, ঘ্রাণযুক্ত জুন-জুলাই
হাড়িভাঙ্গা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়, অত্যন্ত মিষ্টি এবং সুগন্ধযুক্ত আশ বিহীন জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে জুলাই মাসের শুরু পর্যন্ত
সিঁধুরী/সিধু দৃষ্টিনন্দন রঙ (কমলা), মিষ্টি ও ঘ্রাণযুক্ত জুন মাস
মল্লিকা হাইব্রিড জাত, ভারতে উদ্ভাবিত, এখন বাংলাদেশে জনপ্রিয় জুন-জুলাই
গৌড়মতি স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়,পাকলে হলুদাভাব সঙ্গে সিঁদুরে রঙের মিশ্রণে অসাধারণ দেখায়, খোসা ও আঁটি দুটোই পাতলা। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত
রাজশাহীর বিখ্যাত আমের তালিকা অনেক সমৃদ্ধ, কারণ এই অঞ্চলে বিভিন্ন স্বাদের ও গুণগত মানের জাত রয়েছে। এই তালিকাটি রাজশাহীর বিভিন্ন আমের বৈচিত্র্য ও স্বাদের ধারণা দেয়। হিমসাগর আম ২০১৯ সালে GI (Geographical Indication) স্বীকৃতি পেয়েছে। এবং ফজলি আমের GI স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

আম উৎপাদনে রাজশাহী অঞ্চলের গুরুত্ব

আম উৎপাদনে রাজশাহী অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিহার্য। রাজশাহী অঞ্চল বাংলাদেশের আম উৎপাদনের রাজধানী হিসেবে খ্যাত। এটি শুধু পরিমাণে নয়, গুণগত মান, বৈচিত্র্যপূর্ণ জাত, পরিবেশ ও রপ্তানির উপযোগিতা সবদিক থেকেই দেশের আম খাতের কেন্দ্রবিন্দু। উন্নত জাত, অনুকূল আবহাওয়া, বৈচিত্র্যপূর্ণ বাজার এবং রপ্তানিযোগ্য গুণমানের কারণে এটি আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যতম আকর্ষণ।
রাজশাহী বিভাগ তথা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর এবং নওগাঁ অঞ্চলকে মিলিয়ে বলা হয় বাংলাদেশের আম উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলা আম চাষের জন্য বিখ্যাত। এসব অঞ্চলের মাটি দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ প্রকৃতির, যা আম গাছের বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বরেন্দ্র এলাকার উঁচু জমি, দীর্ঘদিন রোদ পাওয়া এবং অপেক্ষাকৃত কম বৃষ্টিপাত আমের মিষ্টতা ও ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়।

এসব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রাজশাহীর আমকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আমের তুলনায় আলাদা করে তুলেছে। দেশের মোট উৎপাদিত আমের প্রায় ৬০–৭০% এই অঞ্চল থেকে আসে। হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি, আম্রপালি, আশ্বিনা, গৌড়মতি, রাণিপছন্দ, লক্ষনভোগ, গোপালভোগসহ শতাধিক জাতের আম পাওয়া যায়। রাজশাহী অঞ্চলে সরাসরি ট্রাক, পিকআপ ও কুরিয়ারের মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশে সরবরাহ হয়।বিশেষ ট্রেন সার্ভিস (আম ট্রেন) চালু করা হয় জুন-জুলাই মাসে (বাংলাদেশ রেলওয়ে দ্বারা)।

যে কারণে রাজশাহীর আম এত জনপ্রিয়

ফলের রাজা আম। রং, আকার, স্বাদ, পুষ্টি আর ঘ্রাণে আমের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশের মাটি, আবহাওয়া, জলবায়ু সব কিছুই আম চাষের উপযোগী হওয়ায় দেশের নানা প্রান্তে কম বেশি আমের চাষ হয়। তবে রাজশাহী অঞ্চলের (বিশেষত রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলা) আম জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কিন্তু কেন, চলুন জেনে নেয়া যাক রাজশাহী অঞ্চলের আমের জনপ্রিয়তার কয়েকটি কারণ।

১. ভৌগোলিক উপাদানঃ রাজশাহী অঞ্চলের ভৌগোলিক উপাদান দেশের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে পৃথক। ভৌগোলিক উপাদান বলতে তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডল, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি বোঝানো হয়। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মোট ১১ জেলায় ৭ লাখ হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে বরেন্দ্র এলাকা। যার মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলায় ১,৬০,০০০ হেক্টর জমি উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল। আর এই অঞ্চলেই সিংহভাগ আম উৎপন্ন হয়। আমের মুকুল গঠনের সময় কিছুদিন একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় থাকলে বিশেষ কুড়ি রুপান্তরিত হয় ফুলে। প্রায় প্রতি বছর আমের মুকুল হবার মৌসুমে রাজশাহী অঞ্চলের তাপমাত্রা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আমের জন্য অনুকূলে থাকে। ফলে গাছে বেশি মুকুল আসে। আর মুকুল বেশি মানেই আমের ফলন বেশি।

২. মাটির গুণাগুণঃ এই অঞ্চলের মাটি আমচাষের জন্য প্রাকৃতিকভাবে অত্যন্ত উপযোগী। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশ কম। এ অঞ্চলের মাটিতে শতকরা ০.৮ থেকে ১.৫ ভাগ জৈব পদার্থ রয়েছে। মাটি খানিকটা অম্লধর্মী যার পিএইচ ৫.২-৬.২ এর মধ্যে থাকে, যা ফলদ বৃক্ষের জন্য আদর্শ। এই pH মাত্রা মাটিতে পটাশ, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের সঠিক শোষণ নিশ্চিত করে। আমের উৎপাদন ও স্বাদে প্রভাব ফেলে মাটির গুণাগুণের কারনে। রাজশাহীতে দোআঁশ ( ও বেলে দোআঁশ মাটি বেশি পরিলক্ষিত হয় এই ধরনের মাটি পানি সহজে শোষণ করে, শিকড় ভালোভাবে বাড়তে সাহায্য করে, মাটিতে অক্সিজেনের সঞ্চালন বজায় রাখে। ঠিক সে কারণেই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, রংপুর, অঞ্চলে আম উৎপাদন বেশি হয় এবং এসব অঞ্চলের আমের স্বাদেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।

৩. বিভিন্ন জাতঃ নানা প্রকার গুটি (আগাম জাত), গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগ বা লখনা, রানিপছন্দ, হিমসাগর বা ক্ষীরশাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি, আম্রপালি, আশ্বিনা, বারি আম-৪, গৌড়মতি, ইলামতি, কাটিমন, বারি আম-১১ সহ অসংখ্য জাতের নানা বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদের আম রাজশাহী অঞ্চলে পাওয়া যায়। বৈচিত্র্যময় জাতের প্রাচুর্যের কারণে এই অঞ্চলের আম এত জনপ্রিয় বলে মনে করা হয়। রাজশাহী অঞ্চলে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের আম কোন সময় থেকে বিক্রির জন্য পাড়া শুরু করা যাবে তার সময় সীমা উল্লেখ করে প্রতিবছর একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। স্থানীয়ভাবে যেটিকে বলা হয় ‘ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার’। ২০১৭ সাল থেকে রাজশাহী জেলায় ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার প্রকাশিত হয়ে আসছে।

৪. আম চাষ পদ্ধতিঃ চাষ একটি লাভজনক ও জনপ্রিয় ফলচাষ পদ্ধতি, বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে। আম গাছে সাধারণত কম পানি লাগে, তবে শুকনো মৌসুমে প্রতি ১৫-২০ দিনে একবার সেচ দেয়া ভালো। কিছুটা অম্লীয় মাটিতে উঁচু ও সুনিষ্কাশিত স্থান নির্বাচন, জমি তৈরি, উপযুক্ত সময়ে চারা রোপণ প্রণালী, পরিমাণ মতো সার ও সেচ দেওয়া, আগাছা দমন, অপ্রয়োজনীয় ডাল-পাতা ছাঁটাই, প্রয়োজনে গাছের মুকুল ভাঙ্গন, রোগ ও পোকা দমন ব্যবস্থাপনা সর্বোপরি অনন্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজশাহী অঞ্চলে আম চাষ হয়। যে কারণে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে এই অঞ্চলের আম। সঠিক পরিকল্পনা, পরিচর্যা, এবং রোগ দমন পদ্ধতি অনুসরণ করে আম চাষে একদিকে যেমন উচ্চ ফলন পাওয়া যায়, তেমনি বাজারজাত করে ভালো মুনাফা অর্জন করাও সম্ভব।

৫. আম সংগ্রহ ও মোড়কজাতকরণঃ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত যত্নের সাথে রাজশাহী অঞ্চলের আম চাষীগণ আম সংগ্রহ করে থাকেন। আম গাছ হতে দুইভাবে পাড়া হয়, হাত দিয়ে এবং সংগ্রাহক (স্থানীয় ভাষায় ‘লগি’ বা ‘লগা’ ও ঠুসি) ব্যবহার করে। গাছ ছোটো হলে হাত দিয়েই পাড়া হয় আর বড় হলে পাতলা বাঁশের তৈরি আম সংগ্রাহক বা ঠুসি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গাছ থেকে আম সংগ্রহ করা হয় মেঘমুক্ত, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এবং সকাল বেলায়। গাছ থেকে পাড়ার পর আমকে কিছুক্ষণ উপুড় করে রাখা হয়, যাতে আঠা ঠিকমতো ঝরে পড়ে ও আমের গায়ে না লাগে। অনেক সময় বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে বারে বারে আম পাড়া হয়। পাড়ার পর আঘাতপ্রাপ্ত, রোগাক্রান্ত, পোকা দ্বারা আক্রান্ত, পাখিতে খাওয়া ও গাছ পাকা আম পৃথক করে রাখা হয়। এরপর প্যাকিং এর পালা। একসময় প্যাকিংয়ে বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহার করা হতো। এখন প্লাস্টিকের ক্রেটসে (স্থানীয় নাম ‘ক্যারেট’) আম পরিবহণ করা হয়। খবরের কাগজ বা নরম খড় দিয়ে স্তরে স্তরে সাজানো হয় ক্রেটস। পরিশেষে নানা মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো হয় রাজশাহীর বিখ্যাত আম।

রাজশাহীর আমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

রাজশাহীর আমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব আপরিসীম। রাজশাহীর আম শুধু একটি ফল নয়, এটি পুরো অঞ্চলের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এ আমকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল কর্মসংস্থান, গ্রামীণ ব্যবসা, পরিবহনব্যবস্থা, বাজার কাঠামো এবং রপ্তানিভিত্তিক আয়। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর এই চার জেলায় লাখ লাখ কৃষক পরিবার আমচাষের উপর নির্ভরশীল। অনেক পরিবারে আমই একমাত্র বা প্রধান আয়ের উৎস।
প্রতি বছর রাজশাহী ও আশেপাশের জেলায় লক্ষ লক্ষ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে একটি বড় অংশ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয় এবং একটি অংশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। প্রতি মৌসুমে হাজার হাজার চাষি ও ব্যবসায়ী আমচাষ ও বিপণনে সরাসরি যুক্ত থাকেন। শুধু আম বিক্রি নয়, আম সংগ্রহ, প্যাকেজিং, পরিবহন, বাজারজাতকরণ সব মিলিয়ে এটি একটি বড় কৃষিনির্ভর শিল্পে পরিণত হয়েছে।

শুধু বানেশ্বর, কানসাট, বাঘা, চারঘাট, ভোলাহাট এই হাটগুলোতেই দিনে ১০–২০ কোটি টাকার আম কেনাবেচা হয়। অনেক যুবক অনলাইনে আম বিক্রি শুরু করে সফল হয়েছে (ফেসবুক, ওয়েবসাইট, অ্যাপের মাধ্যমে)। বাগান পরিচর্যা, গাছ ঝাড়া, বাছাই, প্যাকিং, আড়ত ও পরিবহনে প্রতি মৌসুমে লাখো মানুষের অস্থায়ী চাকরি হয়। নারী ও কিশোররাও প্যাকিং ও বাছাইয়ের কাজে অংশ নেন।

সরকারও আমচাষিদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ে ‘আমের ট্রেন’ নামে একটি বিশেষ ট্রেন চালু করেছে, যা রাজশাহী থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অল্প খরচে ও দ্রুত আম সরবরাহ করে। এতে করে চাষিরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন এবং আমের অপচয়ও কমেছে। তাই রাজশাহীর আমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় এটি শুধু কৃষিপণ্য নয়, বরং একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ইঞ্জিন।

আন্তর্জাতিক বাজারে রাজশাহীর আম

আন্তর্জাতিক বাজারে রাজশাহীর আম ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, বিশেষ করে গুণগত মান ও স্বাদে অনন্য হওয়ায়। হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি ও গোপালভোগ জাতের আমগুলো ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। এছাড়াও যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ও সিঙ্গাপুরসহ বহু দেশে এর চাহিদা রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক রপ্তানির জন্য কিছু মানদণ্ড অনুসরণ করতে হয় যেমন, কীটনাশকমুক্ত চাষ, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংগ্রহ, হট-ওয়াটার ট্রিটমেন্ট ইত্যাদি।

২০২৫ সালে রাজশাহী থেকে প্রায় ৩,৫০০ মেট্রিক টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। এই আমগুলো ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং নতুনভাবে চীনসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। রাজশাহীর আম রপ্তানির ক্ষেত্রে "ফ্রুট ব্যাগিং" প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা আমের গুণগত মান বজায় রাখতে সহায়তা করে। এছাড়াও, চুক্তিভিত্তিক চাষের মাধ্যমে কৃষকরা নির্দিষ্ট মানের আম উৎপাদন করে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করছেন।

মে থেকে জুলাই মাসে আম রপ্তানি সবচেয়ে বেশি হয়, কারণ তখন আমের মৌসুম থাকে। রাজশাহী অঞ্চলের আম উৎপাদন ও রপ্তানি থেকে প্রায় ৯১০ মিলিয়ন ডলার আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এই আয় কৃষক ও রপ্তানিকারকদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ সরকার চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে চীনে আম রপ্তানির পথ সুগম হয়েছে। এটি বাংলাদেশের আম রপ্তানির জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

রাজশাহীতে কোন আম কবে পাওয়া যাবে

রাজশাহীতে আগামী ১৫-ই মে থেকে এখানকার সকল বাজারে গুটি আম পাওয়া যাবে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য জাতের আম বাজারে উঠতে শুরু করবে। আম ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে আম নামানোর সময়সীমা জেলা প্রশাসক নির্ধারণ করে থাকেন। নির্ধারিত সময়ের আগে বাগানের কোনো আম পাকলে উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করে তা নামিয়ে বাজারজাত করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।
রাজশাহীতে-কোন-আম-কবে-পাওয়া-যাবে
রাজশাহী জেলা প্রশাসন এবং কৃষি বিভাগ সাধারণত মে মাসের শুরুতে আম পাড়ার সময়সূচি নির্ধারণ করে থাকেন, যেন কাঁচা আম তোলা ও কার্বাইড দিয়ে পাকানো বন্ধ করা যায়। প্রতিটি জাতের জন্য একটি নির্ধারিত শুরুর তারিখ থাকে। এই তারিখের আগে বাজারজাত করা বা পরিবহন আইনত নিষিদ্ধ। রাজশাহী জেলা প্রশাসনের নির্ধারিত 'ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার' অনুযায়ী রাজশাহীতে বিভিন্ন জাতের আম পাড়ার সময়সূচি নিম্নরূপঃ
আমের নাম বাজারে আসার সময়সীমা পাকার ধরন বৈশিষ্ট্য মন্তব্য
গুটি আম ১৫ মে মৌসুমের প্রথম আম দ্রুত পাকে, আকারে ছোট, টক-মিষ্টি স্বাদ কাঁচা খাওয়া ও আচার তৈরির জন্য আদর্শ
গোপালভোগ ২৫ মে দ্রুত পাকার জাত আঁশবিহীন, রসালো, গাঢ় মিষ্টি সহজে পাকে, বাজারে চাহিদা বেশি
রানীপছন্দ ২৫ মে মাঝারি সময় লাগে পেতে গোলাকার, দেখতে আকর্ষণীয়, মিষ্টি ও সুগন্ধযুক্ত স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়, তবে রপ্তানিযোগ্য নয়
লক্ষণভোগ (লখনা) ৩০ মে দ্রুত পাকে কম মিষ্টি, সুগন্ধযুক্ত, আঁশবিহীন ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ভালো
হিমসাগর (ক্ষীরশাপাতি) ৩০ মে মাঝারি সময়ে পাকে ঘন রসালো, আঁশবিহীন, ঘ্রাণযুক্ত জিআই সনদপ্রাপ্ত, রপ্তানির জন্য আদর্শ
ল্যাংড়া ১০ জুন ধীরে পাকে টক-মিষ্টি, ঘন রস, আঁশ কম দেশব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত
বোম্বাই (ব্যানানা) ১০ জুন মাঝারি সময় লাগে সুগন্ধযুক্ত, পাতলা চামড়া ঘরোয়া ব্যবহারে উপযুক্ত
আম্রপালি ১৫ জুন ধীরে পাকে, দীর্ঘ সময় ধরে আঁশবিহীন, ছোট আকৃতি, রসালো সংরক্ষণযোগ্যতা বেশি, প্যাকেটজাতকরণে ভালো
ফজলি ১৫ জুন ধীরে ও শেষ দিকে পাকে বড় আকৃতির, হালকা মিষ্টি জুস তৈরি ও রপ্তানিতে ব্যবহৃত হয়
বারি-৪ ৫ জুলাই মাঝারি পাকার জাত উন্নত জাতের রসালো ও মিষ্টি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত
আশ্বিনা ১০ জুলাই ধীরে পাকে টক-মিষ্টি, আঁশযুক্ত মৌসুম শেষে বাজারে আসে
সুরমা ফজলি ১৫ জুলাই মাঝারি সময়ে পাকে এর স্বাদ, গন্ধ ও গুণগত মানের জন্য জনপ্রিয়।
গৌড়মতি ১৫ জুলাই দেরিতে পাকে সুগন্ধ ও মিষ্টতা বেশি ঢাকায় ও নারায়ণগঞ্জে চাহিদা বেশি
ইলামতি ২০ আগস্ট দেরিতে পাকে মৌসুমের একেবারে শেষ আম স্বাদে আলাদা, দেরিতে বাজারে আসে
কাটিমন (বারি-১১) সারা বছর পাওয়া যায় কৃত্রিম পরিবেশে চাষযোগ্য ছোট, আঁশবিহীন, মিষ্টি বারোমাসি আম, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনযোগ্য

ফরমালিনমুক্ত আম চেনার উপায়

ফরমালিনমুক্ত আম চেনার কিছু উপায় নিচে দেওয়া হলো, যদিও শতভাগ নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা শুধু চোখের দৃষ্টিতে সম্ভব নয়। ফরমালিনমুক্ত আম চেনা আজকের দিনে ভোক্তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ বাজারে অনেক সময় কৃত্রিমভাবে পাকানো, ফরমালিনযুক্ত বা রাসায়নিক-প্রক্রিয়াজাত আম পাওয়া যায়। ফরমালিনযুক্ত আম মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে আপনার পরিবারের জন্য। নিচে কিছু কার্যকর ও সহজ উপায় তুলে ধরা হলোঃ
১. মাছি বসবেঃ আম কিনতে গেলে একটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল করতে হবে, আমের ওপর মাছি বসে কি না। মাছি ও অন্যান্য পোকা প্রাকৃতিকভাবে পাকা, রসালো ফলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমে রাসায়নিক ফরমালিন বা কার্বাইড দেওয়া থাকলে সে আমের ওপর কখনোই মাছি বসবে না।ফরমালিন বা কার্বাইডের কারণে আমে একধরনের তীব্র, কেমিক্যাল গন্ধ থাকে যা মাছিদের জন্য অপ্রীতিকর।

২. স্বাদ ও গন্ধঃ ফরমালিনমুক্ত আমের স্বাদ ও গন্ধ অনেক বেশি প্রাকৃতিক ও তৃপ্তিদায়ক হয়। স্বাভাবিকভাবে পাকা আম থেকে দূর থেকেই মিষ্টি ঘ্রাণ পাওয়া যায়। আম কেনার পর সেই আম মুখে দেওয়ার পর যদি দেখেন যে আমে কোন সৌরভ নেই কিংবা আমে টক-মিষ্টি কোনো স্বাদই নেই, বুঝবেন যে সে আমে ফর্মালিন জাতীয় কোনো রাসায়নিক দ্রব্য দেওয়া হয়েছে।

৩. আম সাদাটে থাকবেঃ গাছপাকা হলে আমের গায়ে এক ধরনের সাদাটে ভাব থাকে, সেরকম রঙিন ভাব থাকে না। কিন্তু ফরমালিন বা অন্য রাসায়নিক দেওয়া আম হয় সুন্দর, দাগহীন ও পরিষ্কার। আমের ভিতরের অংশ যদি হলুদ বা কমলা রঙের হয়ে থাকে তবে সেটা স্বাভাবিক। বাইরেরটা পাকা দেখালেও কাটার পর যদি দেখেন ভেতরে সাদাটে তাহলে এটি সম্ভবত কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো।

৪. আমের গায়ে দাগ থাকেঃ আমের গায়ে দাগ থাকা অনেক সময়েই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ঘটনা এবং এটি ফরমালিনমুক্ত বা প্রাকৃতিকভাবে পাকা আমের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। গাছে থাকার সময় রোদ, পোকা বা পাতার সাথে ঘষা লাগার কারণে ত্বকে হালকা দাগ হতে পারে। এসব দাগ চামড়ার ওপর হালকা বাদামি বা কালচে রঙের হয়ে থাকে। রাসায়নিকে পাকানো আমের ত্বক হয় দাগহীন। কারণ, কাঁচা অবস্থাতেই পেড়ে ফর্মালিন ও কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়।

৫. খোসায় রঙের ভিন্নতাঃ গাছপাকা আমের গায়ের রং-ও আলাদা। গোড়ার দিকে একটু গাঢ় রং থাকে গাছপাকা আমে। রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পাকানো আমের আগাগোড়া হলদে রং হয়ে যায়। হিমসাগরসহ আরও বেশ কিছু জাতের আম পাকলেও সবুজ থাকে। গাছপাকা হলে এসব আমের ত্বকে কালো কালো দাগ পড়ে। রাসায়নিক দিয়ে পাকানো হলে আমের ত্বক হয় মসৃণ ও সুন্দর।

৬. কেমিক্যাল পরীক্ষার কিটঃ আমে কেমিক্যাল যেমন ফরমালিন, কার্বাইড, ইথেফন আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য বাজারে বা অনলাইনে, ফরমালিন/কার্বাইড পরীক্ষার কিট পাওয়া যায় যা ব্যবহার করা খুব সহজ। এটি ব্যবহার করলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন ফলে কোনো রাসায়নিক পদার্থ আছে কিনা। এটি সাধারণত একটি লিকুইড রিএজেন্ট বা স্ট্রিপ আকারে থাকে। আপনি আমের রস বা টুকরো নিয়ে ওই কিটে প্রয়োগ করলেই বুঝতে পারবেন ফরমালিন আছে কিনা।

রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের হাট বানেশ্বর

রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের হাট হলো বানেশ্বর বাজার, যা রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলায় অবস্থিত। এই বাজারকে বাংলাদেশের আমের রাজধানী বলা হয় এবং এটি দেশের অন্যতম বৃহৎ আমের পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত। এই হাটটি মূলত শনিবার ও মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাট হিসেবে পরিচিত হলেও, আমের মৌসুমে প্রতিদিনই এখানে বেচাকেনা চলে। প্রায় শতাধিক আড়তদার এখানে ব্যবসা করেন, এবং প্রতিদিন হাজার হাজার মণ আম কেনাবেচা হয়।

বাজার এলাকায় সব কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয় রয়েছে, ফলে এখান থেকে আম কিনে সহজেই দেশের যেকোনো প্রান্তে পাঠানো যায়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মৌসুমি আম ব্যবসায়ীরা ভিড় করেন এই হাটে। পাইকারি বাজার হলেও এখানে খুচরা আম কিনতে পাওয়া যায়। তাই অনেকে আসেন পরিবারের জন্যও সুমিষ্ট আম কিনতে। বানেশ্বর বাজারের আশপাশের সড়কগুলোতে এসময় শুধুই আম ভর্তি ভ্যান ও ট্রলির আনাগোনা, সবার গন্তব্য বানেশ্বর বাজার।

এটি রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলা যেমন চারঘাট, বাঘা, দুর্গাপুর, মোহনপুর, পবা, বাগমারা ইত্যাদি থেকে আগত আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের জন্য একটি প্রধান কেন্দ্র। বানেশ্বর হাটে গোপালভোগ, হিমসাগর, লক্ষণভোগ, ল্যাংড়া, আম্রপালি, গুটি জাতসহ বিভিন্ন ধরনের আম পাওয়া যায়। বাজারে পাইকারি ও খুচরা উভয় ধরনের বেচাকেনা হয়। এছাড়া, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে এসে আম কিনে নিয়ে যান।

প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় মুখরিত থাকে বানেশ্বর বাজার। এ বাজার থেকেই আম যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রায় শতাধিক আড়তদার এখানে ব্যবসা পরিচালনা করেন। এই বাজারে পুঠিয়া, চারঘাট, বাঘা, বেলপুকুর, মনিহার, দুর্গাপুরসহ রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গুঁটি, গোপালভোগ, হিমসাগর, লক্ষণভোগ, ল্যাংড়া, আম্রপালিসহ বাহারি আম বাজারে আসে।

ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে এখান থেকে আম কিনেন। এখানে ব্যবসায়ীদের একটা নিরাপত্তার বিষয় আছে। ব্যবসায়ীরা যাতে নির্বিঘ্নে আম বেচা কেনা করতে পারে, তাদের মালামাল নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে এই বিযয় গুলোতে পুলিশ সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমের সময় রাস্তাটা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এ সময় পুলিশরাও বেশ সচেতন থাকে। যাতে চুরি-ডাকাতি না হয়, যানবহন চলাচল স্বাভাবিক থাকে, ট্রাফিকটা সুন্দর থাকে সে বিষয় লক্ষ্য রাখা হয়।

রাজশাহীর বিখ্যাত কয়েকটি আমের বাজার

রাজশাহীর বিখ্যাত আমের বাজারগুলো আমের মৌসুমে সরগরম থাকে। এগুলোতে বিভিন্ন জাতের আম পাইকারি ও খুচরা দরে বিক্রি হয়। এই অঞ্চলের বিভিন্ন বাজারে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার আমের বেচাকেনা হয়, বিশেষ করে মে থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়কালে। এখানে অনেক জনপ্রিয় আমের বাজার রয়েছে, যেখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিদেশেও আম সরবরাহ করা হয়। নিচে রাজশাহী ও আশপাশের বিখ্যাত আমের বাজারগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
রাজশাহীর-বিখ্যাত-কয়েকটি-আমের-বাজার
১. বানেশ্বর বাজারঃ রাজশাহীর সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত আমের হাট বানেশ্বর বাজার। বানেশ্বর বাজার রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি শুধু রাজশাহী নয়, গোটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত আমের হাট হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রতিদিনই বিভিন্ন জাতের আমের বেচাকেনা হয়, যেমন গোপালভোগ, হিমসাগর, লক্ষণভোগ, ল্যাংড়া, আম্রপালি ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে আম কিনতে আসেন। প্রতিদিন রাজশাহী ও আশপাশের এলাকার শত শত চাষি তাদের উৎপাদিত আম এই হাটে নিয়ে আসেন। এখানে এক দিনে ২০–৩০ হাজার মণ পর্যন্ত আম বিক্রি হয়।

২. সাহেব বাজারঃ সাহেব বাজার রাজশাহী শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং এটি রাজশাহীর প্রাচীনতম ও সবচেয়ে জনবহুল বাজারগুলোর একটি। এটি শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারই নয়, আমের মৌসুমে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আমের খুচরা ও পাইকারি বাজারে পরিণত হয়।রাজশাহী শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এই বাজারটি আমের মৌসুমে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকে। এখানে বিভিন্ন জাতের আমের খুচরা ও পাইকারি বিক্রি হয়। রাজশাহী শহরের লোকজন এখানেই সবচেয়ে বেশি আম কেনাকাটা করেন। খুচরা ক্রেতা ও ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য এটি অন্যতম জনপ্রিয় বাজার। গোপালভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি, ফজলি, আশ্বিনা সব জাতের আম পাওয়া যায় মৌসুম অনুযায়ী।

৩. পুঠিয়া আম বাজারঃ পুঠিয়া আম বাজার রাজশাহী জেলার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী আমের হাট, যা মূলত বানেশ্বর বাজারকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়। পুঠিয়া উপজেলা আম চাষের জন্য বিখ্যাত, এবং এখানকার বাজারগুলো আম মৌসুমে বিপুল পরিমাণে বেচাকেনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। পুঠিয়া উপজেলায় হাজার হাজার বিঘা জমিতে আমের বাগান রয়েছে। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া হিমসাগর, গোপালভোগের মতো জাতের জন্য আদর্শ। যদিও অনেক ছোট বাজার ও গঞ্জে খুচরা আম বিক্রি হয়, বানেশ্বর বাজার পুঠিয়া উপজেলার প্রধান পাইকারি আমের হাট। এখানেই চাষিরা তাদের বাগানের আম বিক্রির জন্য আড়তদারদের কাছে নিয়ে আসেন।

৪. বাঘা আম বাজারঃ বাঘা আম বাজার রাজশাহীর বাঘা উপজেলাতে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ আমের হাট, যা মূলত ফজলি আমের জন্য সারা দেশে পরিচিত। এই অঞ্চলের ফজলি আমের আকৃতি বড়, স্বাদ মিষ্টি ও রসালো, যা একে বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত মূল্যবান করে তোলে।এটি রাজশাহীর অন্য এলাকার তুলনায় আকারে বড় ও রসে ভরপুর। অনেক ক্ষেত্রেই একেকটা আমের ওজন ৭০০ গ্রাম–১ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। রাজশাহী শহরসহ আশপাশের জেলা থেকে পাইকাররা আসেন। বিশেষ করে ঢাকায় আম পাঠানোর জন্য অনেক ট্রেডার এখান থেকেই আম কিনে থাকেন।

৫. চারঘাট আম বাজারঃ চারঘাট আম বাজার রাজশাহীর অন্যতম পুরনো ও ঐতিহাসিক আমের হাট, যা রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলাতে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাইকারি আম বাজার, বিশেষ করে হিমসাগর, ল্যাংড়া, ও ফজলি আমের জন্য প্রসিদ্ধ। চারঘাট অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহীর আম উৎপাদনের অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। বাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ আম বেচাকেনা হয়।বানেশ্বর বা বাঘার মতোই এখানে বড় আড়ত রয়েছে। পাইকাররা এখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আম পাঠান — বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি বড় শহরে। চারঘাটে উৎপাদিত হিমসাগর আমের রঙ উজ্জ্বল, রসাল ও আঁশহীন, যা বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়।

৬. গোদাগাড়ি বাজারঃ গোদাগাড়ি আম বাজার রাজশাহী জেলার পশ্চিম অংশে অবস্থিত এবং এটি রাজশাহীর অন্যতম বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ আম উৎপাদন ও বিপণন কেন্দ্র। গোদাগাড়ি উপজেলা ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এখানকার ভৌগলিক আবহাওয়া আম চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এখানকার বাজার মূলত পাইকারি হাট হিসেবে পরিচিত, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ আম বেচাকেনা হয়। মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে ১০০০–২০০০ মণ আম বিক্রি হয়। গোদাগাড়ি আম বাজার রাজশাহীর অন্যতম প্রধান পাইকারি হাট যা বিশেষ করে হিমসাগর, ফজলি, ল্যাংড়া আমের জন্য বিখ্যাত।পাকা আম ছাড়াও অপরিপক্ক আমের ব্যবসা চলে প্রি-অর্ডার (গাছ থেকে) ভিত্তিতে। গোদাগাড়ির বিভিন্ন বাজারে বেশ কিছু আড়ত রয়েছে যারা ঢাকায় সরবরাহের জন্য আম সংগ্রহ করেন।

৭. কানসাট বাজারঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এই বাজারটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ আমের বাজার হিসেবে পরিচিত। এই বাজারটিকে অনেকেই “বাংলাদেশের আমের রাজধানী” বলে থাকেন। এখানে প্রতিদিন মৌসুমে হাজার হাজার মণ আম কেনাবেচা হয় এবং এটি দেশের সবচেয়ে সক্রিয় পাইকারি আম বাজারগুলোর একটি। এখানে খিরসাপাত, ফজলি, ল্যাংড়া, আম্রপালি ইত্যাদি জাতের আমের বেচাকেনা হয়। দেশের সব প্রান্ত থেকে পাইকার, ব্যবসায়ী, ও রপ্তানিকারকরা এখানে আসেন।

কানসাট বাজার শুধুমাত্র একটি পাইকারি হাট নয়, বরং এটি বাংলাদেশে আমের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবেও বিবেচিত হয়। এখানে চাষি, ব্যবসায়ী, আড়তদার ও রপ্তানিকারক মিলিয়ে বিশাল এক বাণিজ্যচক্র গড়ে উঠেছে। ভারতের সাথে সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় ভারতে আম রপ্তানির জন্য অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রাজশাহী অঞ্চলের আমের খ্যাতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, এবং এই বাজারগুলোই তার প্রমাণ।

শেষকথাঃ রাজশাহীর বিখ্যাত আমের তালিকা

রাজশাহী বাংলাদেশের "আমরাজ্য" নামে খ্যাত। এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া আম চাষের জন্য এতটাই উপযোগী যে এখানে উৎপন্ন আমের স্বাদ ও গন্ধ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। রাজশাহীর আম শুধু একটি ফল নয়, এটি একটি সংস্কৃতি, একটি আবেগ। হিমসাগরের মিষ্টতা, ল্যাংড়ার সুবাস ও ফজলির বিশালাকৃতির মধ্যে এক অদ্ভুত মহিমা মিশে আছে। রাজশাহীর আম চেখে দেখলে বোঝা যায়, প্রকৃতি কীভাবে স্বাদ ও ঘ্রাণের নিখুঁত সামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে পারে।

বিভিন্ন ভাষায় আমকে বিভিন্ন নামে ডাকা হলেও আমতো আমই। এর স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ সহ এর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সকলের কাছে জনপ্রিয়তার জায়গা দখল করে নিয়েছে। শুধু তাই নয় আমের যেমন বিভিন্ন জাত র‍য়েছে তেমনি রয়েছে এয় জাতগুলোর নামকরণের পেছনে মজার ইতিহাস। তবে ইতিহাস যায় হোক না কেনো ফলের রাজা আম তার ইতিহাসকে পেছনে ফেলে সেরা উপাধি ধরে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। রাজশাহীর মাটি ও জলবায়ু আম চাষের জন্য আদর্শ।

রাজশাহী অঞ্চলে আম চাষের ইতিহাস শত শত বছরের পুরনো। মুঘল আমলে এ অঞ্চলে আমের গাছ রোপণ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা বিশাল আকার নেয়। সম্রাট শাহজাহানকে পর্যন্ত রাজশাহীর আম পাঠানো হতো উপহার হিসেবে। ঐতিহাসিকভাবে রাজশাহী ছিল "গৌড় বঙ্গ" অঞ্চলের অংশ, যেখানে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আমের উৎপত্তি হয়েছিল। রাজশাহীর আম বর্তমানে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সৌদি আরব, কুয়েত, চীন, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

পচ্ছন্দের ফলটি শুধু খেলেইতো হবেনা বরং এর সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত বিভাগ রাজশাহী এবং এখানকার কিছু সেরা আম সম্পর্কে জানার যে আগ্রহ সেখান থেকেই এই বিষয়টি নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। রাজশাহির আমের পাশাপাশি রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। আশা করছি, রাজশাহীর বিখ্যাত আমের তালিকাসহ রাজশাহী কেনো আমের রাজ্য হিসেবে খ্যাত ও রাজশাহীতে কোন আম কবে পাওয়া যাবে তা জানতে পেরেছেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বিডি টেকল্যান্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটা কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url